ভ্যান চালিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নাচোলের মানিক

কামাল হোসেন:
ইচ্ছেশক্তিই মানুষকে অদম্য করে তোলে। ইচ্ছেশক্তির জোরেই মানুষ বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে সামনে এগোয়। জয় করে শত প্রতিকূল তাকে। ত্রিশোর্ধ্ব মাঈনুদ্দিনও দারিদ্র্যতাকে পেছনে ঠেলে ইচ্ছেশক্তিতে বলীয়ান হয়ে এসএসসির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। পেশায় ভ্যানচালক মাঈনুদ্দিন শুধু নাম নয়, দৃঢ়তার প্রতীক গ্রামবাসীর কাছে।

 
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত নাসিরাবাদ গুচ্ছগ্রাম। এ গ্রামে সরকারিভাবে দরিদ্র মানুষদের বসবাসের জন্য করে দেয়া আবাসনে ঠাঁই নেন মাঈনুদ্দিনের বাবা আবদুল হামিদ ও মা কাকন বেগম। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে মাঈনুদ্দিন বড়। বাবা আনসারের কাজের পাশাপাশি ছোট্ট চায়ের দোকান করতেন। সামান্য আয় দিয়েই চলত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট সংসার। টানাপড়েন ছিল নিত্যসঙ্গী মাঈনুদ্দিনের পরিবারে। তবুও দরিদ্র বাবা সন্তানদের পড়াশোনা করাতে কার্পণ্য করেননি।

 
১৫ বছর আগের কথা। মাঈনুদ্দিন তখন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, বোন তৃতীয় শ্রেণীতে। আর ছোট ভাই তখনো স্কুলে যেতে শেখেনি। এ সময় মাঈনুদ্দিনের পরিবারে নেমে আসে শোকের মাতম। সবাইকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে পরপারে পাড়ি দেন বাবা আবদুল হামিদ। চোখেমুখে অন্ধকার দেখেন মাঈনুদ্দিন। কী হবে সংসারের, কীভাবে চলবে সংসার, নিজের লেখাপড়াইবা করবে কীভাবে- এ রকম হাজারো প্রশ্ন তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। অবশেষে পরিবারের দায়ভার কাঁধে নিয়ে ভ্যানের প্যাডেলে পা রাখেন মাঈনুদ্দিন জীবিকার তাগিদে। সে থেকে আজও তার সঙ্গী ভ্যান। দারিদ্রতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যে কারণে ভ্যানকে অটোভ্যানে রূপান্তর করতে পারছেন না।

 
ভ্যান চালানোর পাশাপাশি লেখাপড়া নিয়মিত চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন মাঈনুদ্দিন; কিন্তু পারেননি। অষ্টম শ্রেণীর পর ছেদ পড়ে লেখাপড়ায়। চারজনের খোরাক জোগাতে দিনের পুরোটা সময় শেষ, লেখাপড়া করবে কোন সময়। ভ্যান চালিয়ে বোনকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর পর বিয়ে দিয়ে দেন। ছোট ভাইকে পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও ভাইয়ের আগ্রহ না থাকায় পঞ্চম শ্রেণীর পর আর এগোয়নি। সেও আয়-রোজগার করে এককভাবে বসবাস শুরু করে।

 
সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত মাঈনুদ্দিন আবারও স্বপ্ন দেখে লেখাপড়া করার। স্বপ্নকে বাস্তবতা দিতে দুই মেয়ের বাবা মাঈনুদ্দিন ২০১৪ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নাচোল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি গ্রোগ্রামে ভর্তি হন। অংশ নেন এসএসসি পরীক্ষায়। চলতি মাসে প্রকাশ হয়েছে এসএসসির ফল। জিপিএ ৩.২৫ পেয়ে পাশ করেছেন মাঈনুদ্দিন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন এইচএসসিতে ভর্তি হবার।

 
নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি দুই মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেছেন। বড় মেয়ে ইয়াসমিন তৃতীয় ও ছোট মেয়ে মরিয়ম দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। আশা, মেয়ে দুটিকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা। কিন্তু তার এ আশার মাঝে নিরাশা দোলা দেয় দারিদ্র্যতার কারণে। এই ভ্যান চালিয়ে মেয়ে দুটিকে কতদূর নিয়ে যেতে পারবে- এ প্রশ্ন পিতা হিসেবে তার নিজের কাছে।

 
মাঈনুদ্দিনের এ সফলতায় গর্বিত তার গ্রামবাসী। গ্রামবাসী জানান, মনের জোর থাকলে কোনো বাধাই বাধা নয়। আর তাই অভাবও মাঈনুদ্দিনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। দেরিতে হলেও ইচ্ছেশক্তির কারণেই সে এসএসসি পাস করতে পেরেছে। মাঈনুদ্দিনের এ চেষ্টায় মুগ্ধ গ্রামবাসী সাধুবাদ জানিয়েছে তাকে।

 
নাচোল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, মানিক ভ্যান চালিয়ে যে লেখাপড়া করে এসএসসি পাশ করেছে এটা আমাদের গর্ব। তাকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করা হবে।

 
নাচোল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের (অবসরপ্রাপ্ত) সহকারী শিক্ষক একরামুল হক বলেন, ভ্যান চালিয়ে এসএসসি পাশ করায় মানিক নাচোলের গর্ব ও এটি প্রথম দৃষ্টান্ত।
স/শ