ভবিষ্যতে আর সত্যি বলবেন না সেই এমপি আবুল কালাম আজাদ

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

নির্বাচনে খরচ করা এক কোটি ২৬ লাখ টাকা তোলার ঘোষণা দিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন নাটোর-১ (লালপুর) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ। বিষয়টি নিয়ে সংবিধান ও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অনেকেই তার শাস্তি দাবি করছেন। এ প্রসঙ্গে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি যে কথা বলেছি তা সত্য এবং সরল বিশ্বাসে বলেছি। তবে এখন মনে হচ্ছে সব সত্য কথা এভাবে বলতে নাই। ভবিষ্যতে এভাবে সত্য কথা বলব না।’

এর আগে নাটোরের লালপুর উপজেলায় ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য আবুল কালম আজাদ। ওইদিন তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এটা আমি তুলবে, যেভাবেই হোক। এটুক অন্যায় আমি করবই। তারপর আর করব না।’

তিনি আরও বলেন, ‘২৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েছি। ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ি কিনেছি ২৭ লাখ টাকা দিয়ে। ইচ্ছা করলে আমি এক কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি কিনতে পারতাম। কিন্তু আমার যেহেতু টাকা নাই, আমি ২৭ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। এবার আমি কিনব, ওই টাকা দিয়ে কিনব। ওই টাকা আমি তুলে নেব। নিয়ে আর কিছু করব না। খালি এই এক কোটি ২৬ লাখ টাকা তুলব।’

আবুল কালাম আজাদ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছেন। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি একজন আইনজীবী। এ ছাড়া আমার আয়ের আর কোনো উৎস নাই। অনেক লোককে সহায়তা করতে হয়। করোনার সময় অনেককে সহায়তা করেছি। এখন আবার পাঁচ বছর করতে হবে। আমি কোথায় টাকা পাব? এক প্রকল্পের টাকা আরেক প্রকল্পে নেব। এক প্রকল্প থেকে টাকা বাঁচিয়ে সেই টাকা দিয়ে মানুষকে সহায়তা করব। এগুলোও দুর্নীতি, অনিয়ম। কিন্তু এ ছাড়া তো আর উপায় নাই।’

তার কথা, ‘সংসদ সদস্য হিসেবে আমার পাঁচ বছরের বেতন-ভাতা এক কোটি ২৬ লাখ টাকা। সেই টাকা তো নির্বাচনে খরচ করে ফেলেছি। তাই আমি সেই টাকা তোলার কথা বলেছি। আর এটা সত্য যে, নির্বাচনে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ের সীমা থাকলেও আমার এক কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সেটা তো আমি বলতে পারবে না। তবে আমি ওই কথা বলেছি মানুষকে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য। এটা ছিল কথার কথা। আমি শেষে বলেছি যে, আমি দুর্নীতি করব না।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে আমি বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। আমি ছাড়া আর কোনো প্রার্থী ছিল না। তখন আমার নির্বাচনে কোনো টাকা খরচ হয়নি। এবার তো হয়েছে।’

এই ধরনের কথা আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন কিনা জানতে চাইলে এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘আসলে সব সত্য কথা এভাবে প্রকাশ্যে বলতে নাই। এটা আমি বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি যে, কিছু কথা গোপন রাখতে হয়। ভবিষ্যতে এভাবে সত্য কথা আর বলব না।’

ওই আসনের সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য মো. শহীদুল ইসলাম বকুল এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে হেরে যান। তিনিও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তার মতে, ‘এমপি সাহেব যা বলেছেন তাতে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আমি নিজেও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছি। দেখি তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায় কিনা।’

এ প্রসঙ্গে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন,‘আসলে দেশে যে আইনের শাসন নেই সেটা ওই এমপি সাহেবের বক্তব্যের পর আবারও প্রমাণিত হলো। কারণ, তিনি সংবিধানের অধীনে শপথ নেওয়ার পর দুর্নীতি করার কথা বলেছেন, এটা সংবিধান লঙ্ঘন ছাড়াও ফৌজদারি অপরাধ। তিনি একজন আত্মস্বীকৃত অপরাধী। কিন্তু এখনো তার বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’

‘যেখানে তিনি ওই কথা বলেছেন, সেই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছেন ইউএনও। তিনিও কোনো আইনগত উদ্যোগ নেননি। দেশে এখন আইনের শাসন নাই। আওয়ামী লীগ যা করবে, তাই আইন। ওই এমপি সাহেব স্বতন্ত্র হলেও তিনি আওয়ামী লীগেরই লোক’, যোগ করেন বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক। তার কথা, ‘এরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। তাই এদের কোনো জবাবদিহিতা নাই। এরা দুর্নীতি করে। এবার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দুর্নীতি শুরু করেছে।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হেসেন এমপি বলেন, ‘এমপি সাহেব ওই কথা যদি বলে থাকেন, তাহলে তা দুঃখজনক। তারপরও তিনি কী ব্যাখ্যা দেন তা দেখার আছে।’

তার কথা, ‘এখন নির্বাচন কমিশন দেখতে পারে যে, তার ওই কথার ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা। আর দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি। হয়তো পরবর্তী সভায় বিষয়টি নিয়ে আলাপ হবে।’

আইন ও সংবিধান কী বলে?

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ওই এমপি যেহেতু নিজেই স্বীকার কছেন যে, তিনি ২৫ লাখ টাকার বেশি নির্বাচনে খরচ করেছেন। আর হিসাব দিচ্ছেন ২৫ লাখ টাকার। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারেন। আর দুর্নীতি করার ঘোষণা দিয়ে তিনি দেশের প্রচলিত আইনেই অপরাধ করেছেন। এটা স্পিকার বা অন্য কোনো সংস্থা দেখতে পারে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘তিনি সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন তো করেছেনই, একই সঙ্গে আমাদের রাজনীতির দেউলিয়াত্ব তার কথায় প্রকাশ হয়েছে।’

তার মতে, ‘সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ মতে, ওই এমপির বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারেন স্পিকার। তিনি বিষয়টি সংসদেও তুলতে পারেন অভিসংশনের জন্য। আর নির্বাচন কমিশন ২৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করার কথা তিনি যেহেতু স্বীকার করছেন, তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’ দলেরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

আর সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেভাবেই হোক ওই এমপি সাহেব মুখ ফসকে সত্য কথা বলে ফেলেছেন। বাস্তব অবস্থা এর চেয়েও খারাপ।’

তার কথা, ‘উনি যেহেতু নির্বাচনে নির্ধারিত সীমার বেশি খরচ করেছেন এবং সেই টাকা আবার দুর্নীতির মাধ্যমে তোলার কথা কলেছেন এটা নৈতক স্খলন। এটার জন্য তিনি দণ্ডিত হতে পারেন। যেহেতু তিনি শপথ নিয়েছেন তাই সংসদকে উদ্যেগ নিতে হবে। স্পিকার যদি নির্বাচন কমিশনে বিষয়টি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠান, তাহলে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য।’