বয়স আর ডাবের ভার নিয়ে রাজশাহীর পথে পথে চাঁন মোহাম্মদ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মুখভর্তি শশ্রু দাড়ি। সেগুলোতে বয়সের ছাপে সাদা রং ধরেছে। মাথার চুলগুলোতেও সাদা রং ছড়িয়েছে। আর শরীরের চামড়াগুলোও কুঁচকে গেছে সেও বয়সের ভারে। তাতে কি? এই ৬৯ বছর বয়সেও যার রয়েছে মনের জোর, সেখানে বয়সের ছাপটুকু আর কিবা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই থামেননি জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া চাঁন মোহাম্মদ। বাঁশের লাঠির ভার করে দুই পারে প্রতিদিন অন্তত ৫০-৫৫টি করে ডাব ঝুলিয়ে নিয়ে সেগুলো কাঁধে তুলে ছুটে বেড়ান রাজশাহী শহরের এমাথা ওমাথা। এই ছুটতে ছুটতেই তাঁর ডাবগুলো বিক্রি হয়ে যায় দিনের কোনো একসময়। এরপর বাড়ি ফেরার তাড়নায় ছুটে যান চারঘাটের নন্দনগাছী এলাকার এই বৃদ্ধি চাঁন মোহাম্মদ।

আমাদের দেশে চাঁন মোহাম্মদের মতো বয়সী অধিকাংশ মানুষই যেখানে নানা রোগ-বালাই কাঁধে নিয়ে কোনো মতে জীবন-যাপন করছেন, সেখানে এই ৬৯ বছর বয়েসে এসে তিনি এখনো ডাবের কাঁদি কাঁধে নিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলেছেন রাজশাহী শহরে। সেই কাকডাকা ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে সকাল ১০টার মধ্যে রাজশাহী শহরে এসে পৌঁছেন তিনি। এরপর শহরের প্রধান রাস্তাগুলো থেকে শুরু করে অলি-গলি ঘুরে ফেরি করে বিক্রি করেন কাঁধের ডাবগুলো। এভাবেই স্বাধীনতাযুদ্ধেরও বছর দুয়েক আগ থেকে ডাব বিক্রি করে চলেছেন জীবনযুদ্ধে হার না মানা চাঁন মোহাম্মদ।

চাঁন মোহাম্মদ জানান, প্রতিদিন তিনি ৫০-৫৫টি করে ডাব কাঁধে নিয়ে শহর ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন। এই ডাবের বোঝা কাঁধে নিয়ে তিনি প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার পথ তিনি ঘুরেন শহরের বিভিন্ন এলাকায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বা কোনো দিন দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় ডাব। এই ডাব বিক্রি করে প্রতিদিন গড়ে তার তিন-চার’শ টাকা আয় হয়। এই আয় দিয়েই তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ থেকেই সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।
চাঁন মোহাম্মদ আরো জানান. তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন ছেলেটিও বাবার সঙ্গে ডাব বিক্রি করতে রাজশাহী শহরে আসেন। তবে ছেলের জন্য একটি চার্জার ভ্যান কিনে দিয়েছেন। ছেলে সেই ভ্যানে করে কোর্ট এলাকায় ডাব বিক্রি করে। তার বয়স বড় জোর ১৫-১৬ বছর। আর বাবা চাঁন মোহাম্মদ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গি কাঁধে করেই ডাব বিক্রি করে চলেছেন এখনো।

রাজশাহী শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকা দিয়ে প্রতিদিন সকালে ডাব নিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায় বৃদ্ধ এই চাঁন মোহাম্মদকে। তাঁকে দেখে যে কারো মনে হবে, কি করে সম্ভব এই বয়সে এই শরীরে এতোগুলো ডাব কাঁধে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা? কিন্তু মনের দিক দিয়ে শক্তিশালী এই চাঁন মোহাম্মদের একটিই কথা, সেটি হলো, ‘যুদ্ধের আগ থেকে এভাবেই পরিশ্রম করি বাবা, তাই সুস্থ আছি। পরিবারের সদস্যদের মুখে এখনো দুইমুঠ ভাত তুলে দিতে পারছি এই ডাব বিক্রি করেই।’

চাঁন মোহাম্মদ জানান, ‘তিনি ডাবগাছের মালিকের নিকট থেকে গাছে থাকা অবস্থায় ডাব কিনে নেন। এরপর সেই ডাব নিজেই পাড়েন। এরপর ভ্যানগাড়িতে করে চারঘাট থেকে ছেলের সঙ্গে রাজশাহী শহরে আসেন। কিছুদিন আগে ছেলেকে ধার-দেনা করে ভ্যানগাড়িটি কিনে দিয়েছেন চাঁন মোহাম্মদ। এরপর থেকে ছেলেও বাবার সঙ্গে রাজশাহীতে ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করে। আর চাঁন মোহাম্মদ ৫০-৫৫টি ডাব নিজেই কাঁধে করে ঘুরে ঘরে বিক্রি করেন। আর বাকি ৫০-৮০টি ডাব বিক্রি করে তাঁর ছেলে সজল আহম্মেদ। এভাবেই দুই বাপ-ছেলে এখন ডাব বিক্রি করে নিজেদের সংসার চালান। কিন্তু ৩ বছর আগেও একাই শুধুমাত্র কাঁধে করে ডাব বিক্রি করেই সংসারের চাকা ঘুরাতে হয়েছে চাঁন মোহাম্মদকে।

চাঁন মোহাম্মদ বলেন, ‘ডাব বিক্রি করি বলে কেউ কাজে-কামে (দিনমজুর) ডাকে না। তাই এই বয়সেও সংসার চালাতে ডাব বিক্রি করে চলেছি। শরীর যতদিন ভালো থাকবে, আর যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এভাবেই হয়তো কেটে যাবে।’

চাঁন মোহাম্মদ আরো বলেন, ‘কত মানুষ সরকার থেকে কত সহযোগিতা পাই। কিন্তু আমাকে কেউ কখনো সহযোগিতার হাত বাড়াইনি। তবে আমি সহযোগিতা চাই না। যতদিন বেঁচে আছি এভাবে যেন সুস্থ শরীর নিয়ে ডাব বিক্রি করে যেতে পারি, শুধু এটুকুই কামনা করি।’