ব্যানার ও মানচিত্র নিয়ে ক্ষোভ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আমেরিকার নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেট ও অ্যাসেম্বলি হাউসে আন্তর্জাতিক আবহে ২৭ মার্চ সপ্তমবারের মতো ‘বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদ্‌যাপিত হয়েছে। এদিন অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আলবেনির ক্যাপিটাল হিলে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল।
নিউইয়র্ক অ্যাসেম্বলি ও স্টেট সিনেটে বাংলাদেশের ৪৭তম স্বাধীনতা দিবসের ওপর পৃথকভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অঙ্গরাজ্যের অ্যাসেম্বলিম্যান লুইস সেপুলভেদা ও সিনেটর জামাল টি বেইলি দুই হাউসে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন। স্টেট সিনেট ও অ্যাসেম্বলির অধিবেশনে প্রস্তাব দুটিতে তুলে ধরা হয় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সিনেট ও অ্যাসেম্বলির গ্যালারি এদিন পুরোটাই শুধু বাংলাদেশিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। উভয় হাউসে শোভা পায় বাংলাদেশের পতাকা। বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে ১২০ জন বাংলাদেশি অংশ নেন।
অ্যাসেম্বলি হাউসের অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশ দিবসের প্রস্তাবটি প্রথমে গৃহীত হয়। এদিন স্থানীয় সময় বেলা ১টায় পবিত্র বাইবেল থেকে পাঠের পর পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াতের মাধ্যমে অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হয়। পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করেন মাওলানা মাসহুদ ইকবাল। এর পর অ্যাসেম্বলি হাউসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে ‘লুইস ভাই’ হিসেবে পরিচিত অ্যাসেম্বলিম্যান লুইস সিপুলভেদা উত্থাপিত বাংলাদেশ দিবস প্রস্তাবনাটি পাঠ করে শোনানো হয়।
প্রস্তাবে বলা হয়, তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকার বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছিল। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয় ৩০ লাখ মানুষ। সম্ভ্রমহানি হয় ২ লাখ মা-বোনের। প্রস্তাবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ করে তাঁদের বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। এর সমর্থনে বেশ কয়েকজন অ্যাসেম্বলিম্যান সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ দিবস প্রস্তাব গ্রহণকালে অ্যাসেম্বলিতে উপস্থিত ছিলেন ‘বাংলাদেশ ডে’ উদ্‌যাপন কমিটির চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বাদশা, লেখক-বিজ্ঞানী ও সিটি কাউন্সিলর মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরান নবী, কমিউনিটি নেতা অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন, নজরুল হক, আবদুল মুসাব্বির, মো. শামীম মিয়া, এ ইসলাম মামুন, আহবাব হোসেন চৌধুরী, জামাল হোসেন ও কামাল উদ্দিন। এ সময় প্রবাসীরা বাংলাদেশিরা হাউস কক্ষের গ্যালারিতে ছিলেন।
বেলা ৪টায় স্টেট সিনেটের অধিবেশনে বাংলাদেশ দিবসের প্রস্তাব গ্রহণ অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করেন মাওলানা মাসহুদ ইকবাল। এরপর সিনেটর জামাল টি বেইলি উত্থাপিত ‘বাংলাদেশ ডে’ প্রস্তাবনাটি পাঠ করে শোনানোর পর পাঁচজন সিনেটর এর সমর্থনে জোরালো বক্তব্য রাখেন। এখানেও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস স্থান পায়। পরে সিনেট হাউসে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
বাংলাদেশ ডে প্রস্তাব উপস্থাপনকালে সিনেটে উপস্থিত ছিলেন ‘বাংলাদেশ ডে’ উদ্‌যাপন কমিটির মুখপাত্র আইনজীবী মোহাম্মদ এন মজুমদার, লেখক-বিজ্ঞানী ও সিটি কাউন্সিল মেম্বার মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরান নবী, কমিউনিটি নেতা সোলেমান আলী ও মাহবুব আলম। এ সময় হাউস কক্ষের গ্যালারিতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা উপস্থিত ছিলেন।
অঙ্গরাজ্যের অ্যাসেম্বলি ও সিনেট হাউসের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সিনেটর জামাল টি বেইলি ও অ্যাসেম্বলিম্যান লুইস সিপুলভেদা আলবেনি হলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্মানে অভ্যর্থনা পার্টির আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে তাঁরা হাউস দুটিতে পাস হওয়া প্রস্তাবের কপি হস্তান্তর করেন। এ সময় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ দিবস উদ্‌যাপন কমিটিকে প্রজেকশন দেওয়া হয়। আবদুর রহিম বাদশার সভাপতিত্বে ও মোহাম্মদ এন মজুমদারের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সিনেটর জামাল ও অ্যাসেম্বলিম্যান সিপুলভেদা ছাড়াও শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন অন্য সিনেটর ও অ্যাসেম্বলিম্যানরা। তাঁরা বাংলাদেশি কমিউনিটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ সময় ঐতিহাসিক এই আয়োজনের জন্য বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে সিনেটর জামাল ও অ্যাসেম্বলি সদস্য সেপুলভেদাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়।
প্রজেকশন পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন—বাংলাদেশ দিবস উদ্‌যাপন কমিউনিটি চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বাদশা, সদস্যসচিব শাহেদ আহমদ, বাফা প্রেসিডেন্ট ফরিদা ইয়াসমিন, কমিউনিটি নেতা আবদুস সহীদ, মামুন’স টিউটরিয়ালের অধ্যক্ষ শেখ আল মামুন, ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন, কমিউনিটি নেতা মোহাম্মদ দলা মিয়া, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হক শাহীন, খলিল বিরিয়ানি হাউসের মালিক মো. খলিলুর রহমান ও কমিউনিটি নেতা রেক্সোনা মজুমদার।
এর আগে ২৭ মার্চ সকাল সাড়ে ৭টায় ব্রঙ্কস থেকে দুটি বাসযোগে প্রায় ১২০ জন প্রবাসী বাংলাদেশ দিবস অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আলবেনিতে যান। বিকেল সাড়ে ৫টায় বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠান শেষ হয়। অংশগ্রহণকারীদের জন্য দুপুরের খাবার পরিবেশন করে ব্রঙ্কসের স্বনামখ্যাত খলিল বিরিয়ানি হাউস।
বাংলাদেশ দিবস উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে যোগদানকারী প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলেন, অ্যাসেম্বলি ও সিনেটে বাংলাদেশকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা অসাধারণ, অনন্য। অঙ্গরাজ্যের দুই হাউসে মহান স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন শুধু প্রবাসীদের নয়, গোটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের।
ঐতিহাসিক বাংলাদেশ দিবস বিলটি পাস হয় ২০১২ সালের ২৪ মার্চ।
এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের প্রধান রূপকার ছিলেন ব্রঙ্কস থেকে নির্বাচিত সাবেক সিনেটর বর্তমান কাউন্সিলম্যান রুবিন ডিয়াজ।
ব্যানার ও মানচিত্র অঙ্কনে বড় গলদ: বাংলাদেশ দিবস উদ্‌যাপনের ব্যানারে ‘বেঙ্গলি ডে’ ও যে মানচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরাসহ পুরো বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক একটি মানচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এই মানচিত্র দেখে অনেক প্রবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
কমান্ডার নূরন নবীর উপস্থিতিতে কীভাবে এমন বিকৃত মানচিত্র ও ব্যানার নিয়ে স্বাধীনতা উদ্‌যাপন করা হলো, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি আবদুল মুকিত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা ভাষার জন্য বাঙালি হতে পারি। তবে আমাদের পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। আমরা অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি, মানচিত্র পেয়েছি। এই অবমাননা সহ্য করা যাবে না। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান ‘বেঙ্গলি ডে’ হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, কমান্ডার নবী দাবি করেন, ‘উনি ব্রেন অফ কাদেরিয়া বাহিনী। এটা উনার ব্রেনে ঢুকল না, এটি পতাকার অপমান, মানচিত্রের অপমান’।
এ নিয়ে কমান্ডার নূরন নবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, ‘বিষয়টি অনিচ্ছাকৃত বলেই মনে হয়েছে আমার। আমরা গিয়েই দেখলাম একটা বড় ভুল হয়েছে। কিন্তু ব্যানারটি তখনই আবার ছাপানোর কোনো সুযোগ ছিল না। অ্যাসেম্বলি ও সিনেটের মূল অধিবেশনে এই ব্যানার ছিল না। বাইরে যে ব্যানার ছিল সেখানে তারা ভুল করেছে। এর জন্য প্রকাশ্যে তারা ক্ষমা চেয়েছে। ২০০ লোকের সামনে ক্ষমা চেয়েছে, এ জন্য আমরা আর বিতর্ক বাড়াইনি।’
এ প্রসঙ্গে একই কথা বলেন এই আয়োজনের অন্যতম সংগঠক ব্রঙ্কস বাংলাদেশ কমিউনিটি কাউন্সিলের প্রধান অভিবাসন আইনজীবী মোহাম্মদ এন মজুমদার। তিনি বলেন, ‘এবার ব্যানার বানানোর দায়িত্ব আমাদের ছিল না। এবার তারা দায়িত্ব নিয়েছিল। এখানে উৎসবের নাম ও বাংলাদেশের মানচিত্র তারা ভুল ছেপেছে। আমরা ১২০ জন মানুষ ছিলাম। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি তারা আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এসেছে। পরে আমাদের মধ্যে অনেকেই ব্যানার ও পতাকা খেয়াল না করেই ছবি তুলে গণমাধ্যমে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আয়োজকদের ইচ্ছা ও মর্যাদাপ্রদানে কোনো ত্রুটি ছিল না। তারা আমাদের সমীহ করতেই এই আয়োজন করেছেন। এই ভুলটি ইচ্ছাকৃত হলে আমরা মেনে নিতাম না, কিন্তু এটা ইচ্ছাকৃত ভুল নয়। এটি অ্যাসেম্বলি ও সিনেটে কর্মরত প্রকাশনা দপ্তরের ভুল। ব্যানারটা ছিল আনঅফিশিয়াল।’

প্রথম আলো