বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনকে চেনে না পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বিজয় দিবসে শহরজুড়ে শোভা পাচ্ছে  জাতির সাত বীরশ্রেষ্ঠের নাম  ও ছবি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন। রাজধানীর বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারের সড়কদ্বীপেও রয়েছে বিজয় দিবসের নানা ফেস্টুন। তবে পথচারীদের অনেকের চোখ আটকে যাচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের ছবির দিকে। ছবিতে রুহুল আমিনকে দেখা গেলেও নিচে নাম লেখা আরেক বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের। এই ফেস্টুনগুলো লাগানো হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। আর মন্ত্রণালয়ের এই ভুলকে ‘বিকৃত এবং ক্ষমার অযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরা। তাদের মতে, জাতির সূর্যসন্তানদের নিয়ে এরকম ভুল কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। লিফলেট কিংবা ব্যানার হচ্ছে যোগাযোগের একটি মাধ্যম, অথচ সেখানে আমরা ভুল প্রচারণা করছি। আর ভুল প্রচারণা মানেই বিকৃত প্রচারণা।

 

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এবং সড়কগুলোতে লাগানো হয়েছে সাত  বীরশ্রেষ্ঠের নাম ও ছবি সম্বলিত ফেস্টুন। মূলত বিজয় দিবসে তাদেরকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং স্মরণ করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা শেফায়েত হোসেন তাদের উদ্যোগ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন, ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ কাজগুলো করা হয়েছে। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং সড়কদ্বীপে সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি এবং নাম দিয়ে এ ফেস্টুনগুলো লাগানো হয়েছে।’

 

কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে মন্ত্রণালয় কাজটি করেছে বলেও জানান তিনি। শেফায়েত হোসেন বলেন, ‘সরকারি কোনও অর্থ এ কাজে খরচ করা হয়নি।’

 

তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি অমার্জনীয় ভুল। এটা হওয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি।

 

এদিকে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘দেশের এক জরিপে পাওয়া গেছে, বিজয় দিবস কবে জানে না দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ, শতকরা ৯৯ ভাগ জানে না সাত বীরশ্রেষ্ঠের নাম। নানা রকমের শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলে এটা হবেই। দেশে ইতিহাস পড়ানো হয় না। গত ২০ বছর ধরে নানা জায়গায় গিয়েছি জাতীয় ইতিহাসকে সবার জন্য পাঠ্য করার জন্য, কিন্তু সায় পাচ্ছি না। ’ তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি -এ তিন বিষয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। নানামুখী শিক্ষা মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে নিয়ে যায়।’

 

জাতীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অবহেলা করা হচ্ছে জানিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের  আমরা কেবল বিকৃতিই দেখছি না, অবহেলাও দেখছি। এই অবহেলা আমাদেরকে রোধ করতে হবে, কারণ এটাও একধরনের বিকৃতি। যারা কাজটা করেছেন তারা বলতেই পারেন, কোনও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই ভুল কিংবা এই বিকৃতি করা হয়নি। এটা নিতান্তই একটা ভুল। কিন্তু আমি বলতে চাই, এই ভুল ক্ষমার অযোগ্য। কারণ, বাংলাদেশের  বীরশ্র্রেষ্ঠের নাম আমরা মনে রাখতে পারব না, তাদের একজনের ছবি দিয়ে আরেকজনের নাম দেবো, এটা হতে পারে না। কারণ, বীরশ্রেষ্ঠ আমাদের একহাজার নয় যে সেই নামগুলো মনে রাখতে পারবো না।  যে ছবিগুলো ব্যানার-ফেস্টুনে ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো আমরা ঠিকমতো শেখাতে পারছি না, কার ছবিতে কার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা খেয়াল করলাম না এটা হতে পারে না।’

 

তুরিন আফরোজ আরও বলেন, ‘এ কারণেই আমি মনে করি, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা দেওয়া উচিত। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের যেসব ব্যানার- ফেস্টুন রয়েছে এগুলো করার চেয়ে না করাই ভালো ছিল। তাদের ভুলের কারণে নতুন প্রজন্ম ভুল শিখছে ও জানছে। তাদের উদাসীনতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

 

তিনি বলেন, ‘তথ্য মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের এখানে ভূমিকা রয়েছে। তাদের এসব বিষয়ে সমন্বয় করা উচিত। বিশেষ করে এত সেনসিটিভ বিষয়ে। একটি সমন্বিত প্রয়াস সবসময় রাখতে হবে, যেন ভুল তথ্য মানুষের কাছে না পৌঁছায়। কারণ একটি ভুল তথ্য একটি বিকৃত তথ্যের সমান।’

 

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সাইফুর মিশু এ বিষয়ে বলেন, ‘অন্তঃসারশূন্য লোকজন দিয়ে আর যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গঠন হবে না। আমি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। অন্তত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় থাকাকালীন এ ধরনের ভুল আশা করি না। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা, যা অর্জিত হয়েছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে।’

 

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এসব ব্যাপারে অনেক সাবধান হওয়া প্রয়োজন জানিয়ে মিশু আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি তথ্য নির্ভুল হওয়া আবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে অন্তত ভালোভাবে জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ  সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, কেবল তাদের পক্ষেই  একজন বীরশ্র্রেষ্ঠের ছবিতে অন্য একজন বীরশ্র্রেষ্ঠের নাম লেখা সম্ভব।’

 

 

এ বিষয়ে কথা বলতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল-ইসলামের মোবাইল ফোনে  একাধিকবার চেষ্টা করা হয়  এবং  খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তা সত্ত্বেও  তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন