বিকশিত হতে হলে চর্চার বিকল্প নেই

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশে এক নতুন রাজনীতি এবং পাশাপাশি একটা নতুন সংস্কৃতির প্রয়োজন দেখা দিল। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতি কখনো আত্মশাসন করেনি। বিদেশি শাসকরা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে দেশটাকে নানাভাবে শাসন-শোষণ করেছে। বাঙালির এত দিনের সংস্কৃতিতে ছিল প্রতিরোধ-প্রতিবাদের সংস্কৃতি। বাংলা ভাষার যে একটা অভিন্ন শিল্প-সাহিত্য ছিল, তা-ও ১৯৪৭ সালের পর ভেঙে যায়। শুধু তা-ই নয়, দুই বাংলার মধ্যে একটা দেয়াল তুলে দেওয়া হয়। সেই সময়ে পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্যে নতুন কিছু উদ্যোগ দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালে যখন ভাষার ওপর আক্রমণ আসে, তখন রাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্যে একটা প্রতিবাদের জোয়ার বয়ে যেতে থাকে। এই জোয়ার স্বল্পকালের জন্য নয়, এর অভিঘাত ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত চলতে থাকে। এই সময়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু সংকোচন, শিল্প-সাহিত্যের ওপর সেন্সর, রবীন্দ্রবিরোধিতা—এসব নতুন জাতীয়তাবাদী চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পথ চলতে থাকে, যার একটা অবধারিত পরিণতি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিল্প-সাহিত্য একটা বড় জায়গাজুড়ে অবস্থান করে। সে সময় কবিতা, গান, এমনকি চলচ্চিত্রে একটা প্রতিবাদী ভাষা লক্ষ করা যায়। কলকাতা, মুম্বাই ও লাহোরের চলচ্চিত্র এ দেশে অবাধে আসতে পারত। তার বিপরীতে পূর্ব বাংলার চলচ্চিত্রকাররা অত্যন্ত শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন। তখনকার চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘আকাশ আর মাটি’, ‘ধারাপাত’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ এবং জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ এ দেশের রাজনীতির পরিপূরক হিসেবে যথার্থই বাঙালির মনে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জহির রায়হানের প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ সারা বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বার্তা পৌঁছে দেয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা একটা জীবন্ত প্রতিবাদ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়ে ঠাঁই পেয়ে যায়।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সাল থেকে শিল্পী-সাহিত্যিকরা একটা নতুন ধারার খোঁজ করতে থাকেন। এই সময়ে পাকিস্তান আমলে এই বাধা-নিষেধের মধ্য দিয়ে শিল্পগুলো বিকশিত হতে পারেনি, তার মধ্যে নাটকে যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় খোঁজেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নতুন, নাটকের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তবু এক ধরনের আবেগ ও উত্তেজনা নিয়ে মঞ্চে নিজেদের প্রকাশে উন্মুখ হয়ে পড়েন। যাঁরা পাকিস্তান আমলে অনিয়মিত নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরাও এই নব নাট্যচর্চায় যোগ দেন। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরে নাটকের জন্য কোনো অবকাঠামো তৈরি হয়নি। ব্রিটিশ আমলে যতটুকু ছিল তা-ও ২৪ বছরে প্রায় ধ্বংসই হয়ে গিয়েছিল। নাটকের জন্য অবকাঠামো লাগে। একটা মিলনায়তন, আধুনিক কিছু সুবিধার প্রয়োজন হয়। সেই প্রয়োজন মেটানোর মতো কোনো স্থান ছিল না বললেই চলে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তন, ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে নাটকের কাজ শুরু হয়ে যায়। ঢাকার বাইরেও রেলওয়ের মিলনায়তন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলরুম, কলেজের অডিটরিয়াম এবং কোথাও কোথাও অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চ নির্মাণ করে নাটক পরিবেশন করা হতো। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ঢাকার মহিলা সমিতিতে একটি মঞ্চ আবিষ্কার করা হয়, মঞ্চটি অত্যন্ত অপরিসর, তার পরও সবটা মিলিয়ে কেমন যেন অভিনয়ের উপযোগী হয়ে যায়।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের তিন বছর পরই ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে একটা বড় ধরনের টানাপড়েন লক্ষ করা যায়। কারণ এই ঘটনার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে আসে সামরিক শাসন। রাজনীতির সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটার যে সুযোগটা তৈরি হয়েছিল তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সামরিক শাসন মানুষের সব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। দেশ গণতান্ত্রিক না হলে নাট্যচর্চা সংকুচিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় কবি, শিল্পী, নাট্যকর্মী, সাহিত্যিকরা একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। আবারও এই পথ প্রতিবাদের পথ হয়ে দাঁড়ায়।

এরই মধ্যে নতুন কিছু নাট্যকারের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ষাটের দশকের কবি-শিল্পীরাও এই আয়োজনে যুক্ত হন। সবার ভাবনা-ভাষা জনগণের কণ্ঠস্বরকে আবিষ্কার করে ছাত্র-জনতার সঙ্গে মিলিত হয়ে স্বৈরাচারবিরোধী সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। পথনাটক, মুক্তনাটক ও মঞ্চনাটকে নতুন হাওয়া লাগে। আশির দশক জুড়ে নাটক, কবিতা, আবৃত্তি, ছোটগল্প, উপন্যাস এক নতুন শক্তি অর্জন করে। কিন্তু এই সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলোও। কেউ কেউ স্বৈরাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ দেশকে ফের পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল।

নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতন হলেও সাম্প্রদায়িকতার উত্থান রোধ করা যায় না। কারণ আগের ১৫ বছরের সামরিক শাসন একটা নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। এই সংস্কৃতিতে ছিল ধর্ম রাজনীতির ব্যবহার, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার, অর্থ ও লুটেরা পুঁজির উত্থান।

রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধস নামার ফলে অনেকেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তবে এরই মধ্যে দেখা গেছে, সঠিক বিচারের আশায় লাখ লাখ তরুণ-তরুণী গণজাগরণ মঞ্চে শামিল হয়। এতেই বোঝা যায়, তারুণ্যের মধ্যে প্রবল প্রতিবাদী শক্তি আছে। শিশু-কিশোররা রাস্তায় স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন করে আসছে। বলতে গেলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কোমলমতি শিশু-কিশোররা পথে নেমেছে। তারা বুঝতে পারে না, কত বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তারা দাঁড়িয়ে গেছে। রাজনীতি মানেই যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নয়, এমপি-মন্ত্রী হওয়া নয়; মানুষের মহোত্তম কল্যাণই যে রাজনীতি—বিষয়টি বুঝতে না পেরে তরুণরা বলে থাকে, ‘আই হেইট পলিটিকস।’

বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের একটা বড় আয়োজন চলছে। কিন্তু এই অবকাঠামো ব্যবহারের যে সংস্কৃতি তা যদি মানুষের না থাকে, তাহলে এসব সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই মানবিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতিচেতনা—এসব যদি মানুষের মাঝে প্রবিষ্ট না হয়, তাহলে সরকারের অনেক ভালো পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। প্রতিদিন দেশে ও বিদেশে বাঙালিদের অনেক সুকীর্তির কথা জানা যায়। এসবকে সাধারণের অনুপ্রেরণার কাজ হিসেবে যদি গ্রহণ করা না যায়, তাহলে সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

একটা বড় অবহেলার জায়গা হচ্ছে আমাদের দেশের উন্নত সংস্কৃতিসম্পন্ন ৪০টি আদিবাসী। তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনসংস্কৃতি আছে। সুদীর্ঘ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সঙ্গে আমাদের সশস্ত্র লড়াই হয়েছিল, তারও একটা ইতি টানা হয়েছিল পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু সেই চুক্তিটিও যথার্থভাবে কার্যকর হয়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাণী হচ্ছে—সব মানুষ যেন তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ফল এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমরা এসব আদিবাসীর (বর্তমান সরকারের ভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী) প্রতি কি যথাযথ সম্মান দেখাতে পেরেছি?

সমালোচনার ভারটা হয়তো বেশি হয়ে গেল, কিন্তু আমরা চাই এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে অনাগত দিনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা আগামী ৫০ বছর, ১০০ বছর এগিয়ে যাক। এ ক্ষেত্রে তাদের যে বিষয়টিতে মনোযোগ দিতে হবে সেটা হলো চর্চা। শিল্প-সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে সহজাত প্রতিভার পাশাপাশি চর্চার দরকার হয়। আমরা মফস্বল শহর থেকে এসে সাংগঠনিক চর্চার মাধ্যমে নিজেদের তৈরি করেছিলাম। প্রযুক্তির এই যুগের প্রজন্ম চর্চার বিষয়ে অনেকটাই অমনোযোগী। সাহিত্য, চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীতে সামনে আরো বিকশিত হতে হলে চর্চার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ