বিআরটিএকে নিয়ে দুদকের গণশুনানিতে নাগরিকদের ক্ষোভ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

‘রাজীবদের মতো তরুণ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে অদক্ষ চালকদের হাতে। সড়কে মানুষ হত্যার এ দায় বিআরটিএ কীভাবে এড়াবে।’ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সেবা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আয়োজিত গণশুনানিতে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কেরানীগঞ্জের বেদৌরা আলী। অদক্ষ ও অপেশাদার চালকদের হাতে সড়কে নিয়মিত দুর্ঘটনার চিত্র উঠে আসে আরও অনেকের বক্তব্যে।

বিআরটিএর মেট্রো উত্তর, দক্ষিণ ও মেট্রো-৩ অঞ্চল নিয়ে গণশুনানিতে কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন সেবাগ্রহীতারা। আজ সোমবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি নিরাপদ সড়ক চাই–এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বিআরটিএর কার্যক্রম আরও আধুনিক করার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে গাড়ির ফিটনেস কাগজনির্ভর। কাগজপত্র ঠিক থাকলে চোখে দেখার মাধ্যমে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হয়। এটাকে পরিবর্তন করার ওপর তাগিদ দেন তিনি।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দেশে ১১ লাখ চালকের ঘাটতি আছে। তারপরও গাড়ি চলছে। এসব গাড়ি চালাচ্ছেন অদক্ষ চালকেরা। তাঁর প্রশ্ন, এটা দেখার দায়িত্ব কার? তিনি বলেন, অনেক চালকের জীবনের মায়া থাকে না। মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে অনেকের মানবিক বোধও থাকে না। তাঁরা নিজেদের রাস্তার রাজা মনে করেন। বিআরটিএর সমালোচনাও করেন তিনি। কাঞ্চন বলেন, কারও কিছু ঘটার আগে বিআরটিএ কিছুই করে না। ঘটার পরই তাদের তোড়জোড় বেড়ে যায়।

২০১৬ সালের ৯ মে বিআরটিএর তিনটি অঞ্চল নিয়ে একটি গণশুনানির আয়োজন করেছিল দুদক। এবারেরটি ছিল তার ফলোআপ। দুই বছর আগে শুনানিতে যেসব অভিযোগ উঠেছিল, তার কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে তার মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে এ আয়োজন। দেখা গেল, তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। এবারের শুনানির তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর কিছু কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারীদের কয়েকজনকে ডেকে কথা বলেছেন বিআরটিএর কর্মকর্তারা।

শুনানিতে বিআরটিএর কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দুর্নীতি, সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে গাফিলতি, দালালদের দৌরাত্ম্যসহ নানা বিষয়ে অভিযোগ উঠে আসে।

গণশুনানিতে আসেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। ছবি: প্রথম আলো              গণশুনানিতে আসেন বিভিন্ন পেশার মানুষ।

দোহারের প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম দুই বছর আগে অভিযোগ করেছিলেন গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বিষয়ে। বিআরটিএর এক কর্মকর্তা বললেন, এ বিষয়ে নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। চালকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তিও দেওয়া হয়। এ সময় দর্শক সারি থেকে গণপরিবহনে ভাড়ার নৈরাজ্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা হয়। একই উত্তর আসে কর্মকর্তাদের কাছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কথা তুলে ধরেন তাঁরা। তখনই ক্ষুব্ধ এক সেবাগ্রহীতা জানতে চান একটি পরিবহন কোম্পানির নাম, যেটি বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া নিয়ে সড়কে চলে। এর সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর আসেনি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। এ সময় দুদকের কমিশনার নাসিরউদ্দীন আহমেদ ১৫ দিনের মধ্যে দুদককে তথ্য জানোর নির্দেশ দেন।

ধানমন্ডির রেহানা সালাম জানান, দুই বছর আগে গাড়ির মালিকানা হস্তান্তরে হয়রানির অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন। এবারের শুনানিতেও তিনি জানান, তাঁর সমস্যাটি সমাধান হয়নি। কয়েক দিন আগে বিআরটিএর এক কর্মকর্তা তাঁকে সমস্যাটির কথা জানতে চেয়ে ফোন করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আশা করছি এবার হয়তো পাব।’

একই ধরনের সমস্যার কথা তুলে ধরেন আসলাম সেরনিয়াবত নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি দুই বছর আগে তিনটি গাড়ির মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে হয়রানির অভিযোগ করেন। দুই বছরেও তাঁর সমস্যার সমাধান হয়নি। জানালেন, এবারের গণশুনানির আগে ফোন পেয়েছেন বিআরটিএ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। বললেন, হয়তো গণশুনানির কথা শুনে বিআরটিএর ওই কর্মকর্তা সক্রিয় হয়েছেন। এ ব্যবসায়ী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমার সমস্যার সমাধান করার দায়িত্ব বিআরটিএর। কিন্তু তাদের জন্য আমাকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। তারা সমস্যার সমাধান দিতে না পারলে বলে দিতে পারত। আমি গাড়িটি ধোলাইখালে নিয়ে গেয়ে স্ক্র্যাপ বানিয়ে বিক্রি করে দিতাম।’

পুলিশি হয়রানি ছাড়া লাইসেন্স কীভাবে পাওয়া যাবে, সেটা জানতে চান গাড়িচালক শামসুল হক। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এফ আর খান দালালদের দৌরাত্ম্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, দেশর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্ত সহজে পৌঁছানো গেলেও বিআরটিএর একজন সহকারী পরিচালকের কাছে সমস্যা নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান এ সময় বলেন, গণশুনানিতে যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। মোবাইল কোর্ট জোরদার করা হবে।

দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) নাসিরউদ্দীন আহমেদ বলেন, দুই বছর আগে ওঠা অভিযোগ এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি না হওয়া বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সীমাহীন উদাসীনতা, দায়িত্ব পালনে চরম অবজ্ঞা ঔদ্ধত্যের শামিল। জনগণ এই ঔদ্ধত্য সহ্য করবে না।

পরিবহন নিয়মমতো চলছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব বিআরটিএর। বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সতর্ক করে তিনি বলেন, মন্ত্রী, সাংসদ, বড় সরকারি কর্মকর্তা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, যা ইতিমধ্যেই দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছেন। যার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।