বার বার পদ্মায় ভাঙে ঘর, তবুও মাটির টানে টিকে থাকার লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর পবা উপজেলার পদ্মার চরের ষাটার্ধ বাসিন্দা জালাল উদ্দিন। বাপ-দাদার আমল থেকে ছিলেন চর খানপুরের বাসিন্দা। জালাল উদ্দিনের নিজেরই ছিল প্রায় ৬০ বিঘা জমি। ছিল গোয়াল ভরা গরু। চরের জমির ধান দিয়েই সংসার চলতো সারা বছর। আবার ধান বিক্রি করেই অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটাতেন জালাল উদ্দিন। এগুলা এখন কেবলই স্মৃতি।

 

  • বছর বিশেক আগের কথা। পদ্মার গর্ভে একে একে জমি বিলিন হতে হতে একসময় বাপ-দাদার বাড়িতেও আঘাত হানে পদ্মা। জালাল উদ্দিন নিজেই একটি বাড়ি তৈরী করেন পরিবারের সদস্যদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু সেই বাড়িটিও গিলে খায় পদ্মা। পরে আবারো নিজের আরেকটি জমিতে তৈরী করেন বাড়ি। এভাবে বছরের পর বছর ধরে পদ্মা বাড়ি গিলে খাই, আর জালাল উদ্দিন আরেকটি জমিতে বাড়ি তৈরী করেন।

rajshahi-photo-18-09-16-16-copy

একসময় এসে জালাল উদ্দিনের শেষ আশ্রয়স্থলও তলিয়ে যায় পদ্মার গর্ভে। এটি বছর চারেক আগের কথা। এরপর জালাল উদ্দিন খানপুর চর ছেড়ে পরিবার নিয়ে আশ্রয় গড়েন পদ্মার মাঝখানে জেগে উঠা মাঝচরে। এই চরের প্রথম বাসিন্দা তিনি। তখন থেকে সেই চরেই স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছিলেন।
কিন্তু সর্বনাশা পদ্মা সেই বাড়িটিও এবারকার বর্ষায় তলিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তাতেও দমে জাননি জালাল উদ্দিন। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার নতুন করে গড়েছেন সেখানেই মাথা গোঁজার আশ্রয়।

 

  • জালাল উদ্দিন বলেন, ‘একে একে সবমিলিয়ে গত ২০-২৫ বছরে আমি ঘর হারিয়েছি কমপক্ষে ১৪ বার।এখন শেষ সম্বল নিজের বাড়ির ভিটে টুকুও আর নাই। কিন্তু তারপরেও এই চরের মায়া আমাকে দূরে থাকতে দেয় না। বার বার ঘর তলিয়ে যায় বলে দুই-ছেলে চর ছেড়ে গিয়ে শহরের বাড়ি করেছে। (চর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে। পদ্মার তীরবর্তি রাজশাহী নগরীতে) সেখানেই তারা থাকে। মাঝে মাঝে মাঝে আমিই যাইয়ে তাদের খোঁজ লিয়ে আসি। কিন্তু চর ছ্যাড়ি য্যাতে আমাক ভাল লাগে না। তাই এই বয়সেও স্ত্রীকে লিয়ে চরেই পড়ে আছি। সেও চর ছ্যাড়ি য্যাতে চায় না।’

rajshahi-photo-18-09-16-22-copy
জালাল উদ্দিন অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘যাবেই বা কেন, এই চরেই যে বাপ-দাদারা শুয়ে আছে। আমরা তাদের র‌্যাখি কিভাবে যাব। চর ছ্যাড়ি গ্যালে তাদের আত্মা কষ্ট পাবে। তাদের কষ্ট দিয়ে আমরা য্যাতে পারি না।’

 

  • পদ্মার মাঝ চরের আরেক বাসিন্দা জুলেখা বিবি। স্বামী-সন্তান নিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার তাঁর। জন্ম নেওয়ার পর থেকেই চরেই বসবাস তাঁর। চরের এ নারীরও বয়স এখন প্রায় ৬০ বছর। এই বর্ষায় জালাল উদ্দিনের মতো তারও শেষ আশ্রয়স্থল বেড়ার দুই কক্ষের বাড়িটি তলিয়ে গেছে। ঘরের টিন ছাড়া কিছুই সেখান থেকে নিতে পারেন জুলেখা বিবি। এর আগেও জুলেখা অন্তত ১২ বার হারিয়েছেন বাড়ি। পদ্মার জোয়ারের তোড়ে জমিসহ ঘর হারাতে হারাতে এখন নি:স্ব প্রায় জুলেখা।

 

সংসারে স্বামী-সন্তান ছাড়া যেন কিছুই নেই তার। সুষ্ক মৌসুমে পরের জমিতে কাজ সংসার চালান জুলেখা। সঙ্গে স্বামী-সন্তানও কাজ করেন। তবু চরই যেন তার শেষ ভরসা। বার বার ঘর ও শেষ সম্বল হারিয়েও চরেই পড়ে রয়েছেন জুলেখার পরিবার। চর পার হয়ে কিছু দূরেই রাজশাহী শহরে। যেখানে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে নতুন করে আশ্রয়ের খোঁজে, নতুন করে জীবন গড়ার তাগিদে এসে বাসা বাঁধছেন শত মানুষ।

 

rajshahi-photo-18-09-16-21-copy

শহর থেকে সামান্য অদূরের এই বাসিন্দা ইচ্ছে করলেই ইট-পাথর আর কংক্রিটের দেয়ালের পাশে মাথা গোঁজার ঠাঁইটি গড়ে নিতে পারেন। কিন্তু চরের মায়া ছেড়ে জুলেখা আসতে নারাজ। তাই বার বার পদ্মার জলের তোড়ে তার শেষ সম্বলটি ডুবে গেলেও মনের জোর কখনো ডুবেনি জুলেখার।

 

  • সেই জোরেই এখনো টিকে আছেন দুর্গোম পদ্মার চরে। যেখানে নাই বিদ্যুৎ, নাই বিশুদ্ধ পানির সহজলোভ্যতা, নাই চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা, নাই পরিবারের ছেলে-মেয়েদের জন্য তেমন শিক্ষার ব্যবস্থা। কিন্তু তারপরেও কোনো এক অজানা মায়ারা টানে এখনো পড়ে আছেন জুলেখা বিবি।

rajshahi-photo-11-09-16-31-copy
পদ্মার চর খিদিরপুরের বাসিন্দা হযরত আলী। তিনিও বাপ-দাদার আমল থেকে এই চরেই বসবাস করছেন। এরই মধ্যে পদ্মা তার বাড়ি তলিয়ে নিয়েছে, অন্তত ১৫ বার। কখনো কখনো সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্রগুলোও সামলাতে মারেননি হযরত আলী। সব পানির তোড়ে ভেসে গেছে। আবার দূর্গম এলাকার বাসিন্দা বলে নিজের ৬ ছেলে মেয়েকেও না পেরেছেন শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে, আবার না পেরেছেন কর্মজীবী হিসেবে গড়ে তুলতে।

 

  • তাই বাধ্য হয়ে কিশোর বয়স থেকেই কখনো গরুর রাখাল হিসেবে আবার কখনো কোনো মতে নদীতে মাছ শিকার করে জীবন চালান হযরত আলীর ছেলেরা। অথচ চর খিদিরপুর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে শহরের অনেক বাসিন্দা রিকশা চালিয়েও তিন বেলা পেট পুরে খেয়ে-দেয়ে অনেকটা ভালভাবেই সংসার চালাতে পারেন। কিন্তু চরের বাসিন্দা হওয়ায় কখনো কখনো কাজ না পেয়ে বসে থেকে অনাহারে-অর্ধহারেই থাকতে হয় হযরতদের। তবুও চরের মাটির ভালবাসার টান ছেড়ের তারা শহরের ইট-পাথরের দেয়ালের মাঝে আশ্রয়  গড়তে পারেননি।

রাজশাহীরর চরের শুধু এই তিনটি পরিবারই নয়, তাদের মতো রাজশাহী নগরীর পাশেই অবস্থিত পদ্মার চর খানপুরে, চর মাঝাড় দিয়াড়, চর খিদিরপুর ও নতুন চর মিলে মোট চারটি চরে অন্তত ২৫ হাজার মানুষ আঁকড়ে ধরে আছেন চরকে। এই মানুষগুলো বার বার হারিয়েছেন বাড়ি-ঘরসহ শেষ আশ্রয়স্থ।

 

কখনো পানির তোড়ে ভেসে গেছে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও। কিস্তু এখনো তারা পড়ে আছেন চরের মাঝেই। বর্ষা মৌসুমে যখন কোনো কোনো চর ডুবে পানি থৈ থৈ করে, তখনো সাহস হারান না এই চরের বাসিন্দারা। পানির মধ্যেই যেন তারা নতুন জীবনের আশ্রয় খুঁজে পান।

  • rajshahi-photo-18-09-16-13-copy
    স্থানীয় হরিয়ান ইউপি চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বলেন, ‘হরিয়ান ইউনিয়নের আওতায় পদ্মার তিনটি চর রয়েছে। এসব চরগুলোতে একসময় হাজার হাজার একর জমি ছিল। চরের প্রায় সব মানুষই ছিল আত্মনির্ভরশীল। কিন্তু এখন তারা সবাই প্রায় নি:স্ব। কিন্তু তার পরেওই চরের মায়া ছেড়ে তারা আসতে পারে না। ঘর ভাঙলে আবার নতুন করে ঘর গড়েন তারা। জমি হারান, কিন্তু নিজের মনোবলকে হারাননি তারা। তাই এখনো পড়ে আছেন চরেই।’

রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন বলেন, দূর্গম চর এলাকার বাসীন্দারা এখন অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করে। তাদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে আমি বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। এগুলো কিছু কিছু এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আবার সামনে আরো অনেক কাজ বাকি রয়েছে। এগুলো করতে পারলে কিছুটা হলেও উপকৃত হবে চরের অবেহিলত মানুষগুলো।’

স/আর