বাংলাদেশ ও ইউরোপের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু

চট্টগ্রাম বন্দর ও ইউরোপের বন্দরের মধ্যে শুরু হয়েছে সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচল। এর ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যোগ হলো নতুন মাত্রা। সাশ্রয় হবে সময় ও অর্থ। ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানি হবে সহজতর।

বাংলাদেশ-ইতালি সরাসরি কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ইউরোপ সমুদ্র বাণিজ্যে খুলে গেল নতুন দুয়ার।

আগে ইউরোপে পণ্য রপ্তানি হতো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মাধ্যমে। সেখানে বেশ সময় ব্যয় হতো। কখনো কখনো যথাসময়ে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হতো না।

সমুদ্রপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় এখন থেকে আর ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের ধকল পোহাতে হবে না। ইউরোপের বাজারে পণ্য পাঠাতে আগে যেখানে এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সময় লাগত, এখন সেখানে লাগবে ১৭ দিন। খরচও কমবে প্রায় ৪০ শতাংশ।

শনিবার দুপুর ১টার দিকে ইতালি থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-৪ জেটিতে ভিড়ে এ রুটের প্রথম জাহাজ ‘এমভি সোঙ্গা চিতা’।

গত ১৭ জানুয়ারি এটি ইতালির রেভেনা বন্দর থেকে রওনা দেয়। আসার সময় জাহাজটি নিয়ে এসেছে প্রায় ৯০০টি খালি ও সাতটি পণ্যবোঝাই কনটেইনার।

ইউরোপের ক্রেতাদের কেনা বাংলাদেশের গার্মেন্টপণ্য নিতে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। এখান থেকে তৈরি পোশাকবোঝাই ৯৮৩ কনটেইনার নিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা রয়েছে জাহাজটির। সেখান থেকে ক্রেতারা নিজ নিজ পণ্য নিয়ে যাবেন। এ জাহাজে জার্মানির ক্রেতাদের পণ্যও রয়েছে। তারা ইতালি থেকে এগুলো সড়কপথে নিয়ে যাবেন।

এর আগে গত ২৩ ডিসেম্বর প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ইতালি থেকে চট্টগ্রামে সরাসরি জাহাজ আসে। তাতে সফল হওয়ার পর শনিবার থেকে শুরু হলো পণ্য পরিবহণ।

সমুদ্রপথে দেশের আমদানি রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশই হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে শীর্ষে আছে তৈরি পোশাক; যার বেশিরভাগই যায় ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ইতালি থেকে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ভিড়েছে। পোশাক রফতানির গুরুত্ব বিবেচনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতালি-চট্টগ্রাম রুটের জাহাজকে বার্থিং, কি গ্যান্ট্রি ক্রেন বরাদ্দসহ সব সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবে।

তিনি আরও বলেন, ইউরোপের সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি জাহাজ যোগাযোগ এই প্রথম। এতে সুফল পাবেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। সরাসরি জাহাজ যোগাযোগ হলে মাঝখানে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে যে সময় ব্যয় হতো, তার আর প্রয়োজন হবে না। আমাদের রপ্তানিকারকরা কম সময়ে পণ্য পৌঁছাতে পারবেন ইউরোপের বাজারে। এ থেকে তারা লাভবান হবেন। দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে। দেশের সার্বিক উন্নতির এটা একটা মাইলফলক।

সমুদ্র-বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, এতদিন চট্টগ্রাম থেকে ফিডার জাহাজ রপ্তানি পণ্য নিয়ে যেত সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাংয়ের মতো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে। সেখান থেকে বড় জাহাজে তুলে সেই পণ্য নিয়ে যাওয়া হতো ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে। চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে পাঠানো এবং সেখান থেকে পুনরায় ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছাতে সময়ক্ষেপণ ও ব্যয় বেশি হতো।

এ পদ্ধতিতে ইতালিতে পণ্য যেতে স্বাভাবিকভাবে সময় লাগে প্রায় এক মাস বা তারও বেশি। ট্রন্সশিপমেন্ট বন্দরে বড় জাহাজে বুকিং পেতে দেরি হলে লাগে দেড় মাস পর্যন্ত। অথচ সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে সময় লাগে মাত্র ১৭ দিন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যে জাহাজটি শনিবার চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে তা পাঠিয়েছেন মূলত তৈরি পোশাক ক্রেতারা। বড় রফতানিকারক ও বায়াররা জোট করেই এ রুটে আপাতত জাহাজ আনবেন বলে জানা গেছে। করোনার স্থবিরতায় জাহাজ সংকটসহ নানা জটিলতায় বাংলাদেশের উৎপাদিত গার্মেন্টপণ্য বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পাঠাতে চরম বেগ পেতে হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। এ অবস্থায় ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে নিজেরাই জাহাজ পাঠাতে রাজি হয়েছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ইউরোপের সরাসরি জাহাজ চলাচল একটা বড় অর্জন। এখন ১৬-১৭ দিনে ইউরোপে পণ্য পৌঁছে যাবে। তাই খরচ কমে আসবে। সময় মতো ক্রেতার কাছে পণ্য পাঠানো সম্ভব হবে। আসার সময় এই রুটের জাহাজগুলো খালি কনটেইনার নিয়ে আসতে পারবে। তাই কনটেইনারের সংকটও হবে না।

তিনি জানান, তৈরি পোশাকের বড় বায়াররা একত্রিত হয়ে সার্ভিসটি দিয়েছে। আপাতত এভাবেই এ রুটে জাহাজ চলবে।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, প্রাথমিক অবস্থায় একটি বিদেশি শিপিং কোম্পানির দুটি জাহাজ এই রুটে চলাচল করবে। এর একটি হলো এমভি সোঙ্গা চিতা ও অপরটি ক্যাপ ফ্লোরেস। প্রতি মাসে অন্তত একটি করে ট্রিপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। রুটটি জনপ্রিয় হলে পর্যায়ক্রমে তারা আরও জাহাজ বাড়াতে পারে।

এমনকি ইউরোপের অন্যান্য বন্দরেও সরাসরি পণ্য নিয়ে যেতে পারে। অন্য শিপিং কোম্পানিও জাহাজ চালাতে পারে।

জাহাজ দুটির লোকাল এজেন্ট রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ জানান, ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ যোগাযোগ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপে কনটেইনার পাঠাতে সময় লাগে ৪০ দিন। সরাসরি পাঠাতে লাগবে ১৭ দিন। এর ফলে খরচ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে আসবে। তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে জাহাজ ভাড়া বিদেশি ক্রেতাই বহন করে থাকে। তাই কোন জাহাজে পণ্য পাঠানো হবে তা নির্ভর করে ক্রেতার পছন্দ-অপছন্দের ওপর।

আসার সঙ্গে সঙ্গে এমভি সোঙ্গা চিতাকে বার্থিং দেওয়ায় ইউরোপসহ বহির্বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে বলে জানান তিনি।

 

সূত্রঃ যুগান্তর