রবিবার , ৩০ জুন ২০২৪ | ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

বন্দে আলী মিয়া: সুনিপুণ চিত্রকুশলী | জুনান নাশিত

Paris
জুন ৩০, ২০২৪ ৭:৫৫ অপরাহ্ণ

কবি বন্দে আলী মিয়ার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতীর চর’ [১৯৩২]। তিরিশের দশকে রবীন্দ্রবিরোধিতার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় যখন পালাবদল চলছিলো তখন এ কাব্যের প্রকাশ। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে ডি এস লাইব্রেরি থেকে। যদিও কবির কাব্যজীবনের শুরু এরও বছর দশেক আগে ১৯২২ সালে। কবি বন্দে আলী মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৬ সালে পাবনার রাধানগর গ্রামে। কবি লেখালেখি শুরু করেন স্কুল জীবন থেকেই। একই সঙ্গে তার চিত্রশিল্পেও হাতেখড়ি ঘটে। ‘জীবনের দিনগুলি’ গ্রন্থে কবির ভাষ্য এরকম:
‘আমি সে সময়ে বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কবিতা লিখবার চেষ্টা করি। কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণ-চোখের সম্মুখে জগত স্বপ্নময়। সেই স্বপ্নের আনন্দ ও বেদনার ছবি-কাকেও দেখাতে পারি না। অতিশয় সংকোচ আর লজ্জা। সহপাঠী বন্ধুদের দেখালে তারা মনে করবে, হয়তো কোনো বই থেকে কারো লেখা নকল করে বাহবা নেবার জন্যে তাদের কাছে আমার নিজের বলে বলছি। তবুও লিখি এবং খাতাটা সযত্নে লুকিয়ে রাখি।’

কবি বন্দে আলী মিয়া শহরতলীর এক গ্রামের বাসিন্দা হলেও লেখালেখির জন্যে উৎসাহ, উদ্যম আর যথার্থ পরিবেশ তিনি পেয়েছিলেন। বিশেষ করে তিনি তাঁর মামার কথা স্মরণ করেন এভাবে: ‘আজ বিশেষ করে একজনের কথা বারে বারে মনে পড়ে। তিনি আমার মধ্যম মাতুল মরহুম আব্বাস আলী সাহেব। শৈশবে চিত্রকল্প ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তাঁর আনুকূল্যেই আমার মনে অঙ্কুরিত হয়েছিল। তাঁর ঘরে আলমারী ভরা গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছোটদের বই আর কয়েকখানি কাব্যগ্রন্থ ছিল।… তাঁর নিকট থেকে নিয়মিত বই নিয়ে পড়বার সুযোগ আমি পেয়েছি।’ কবি প্রবেশিকা পাশের পর কলকাতা পাড়ি জমান। কলেজে পড়াশোনা না করে ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন।

কবি সমসময়ই কলকাতার সাহিত্যের উঁচুমহলে চলাফেরা ও উঠবস করার সুযোগ পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ সে সময়ের খ্যাতিমান প্রায় সব সাহিত্যিকের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু কবি হিসেবে বন্দী আলী মিয়া নিজেকে নিবিড়ভাবে প্রোথিত করেছেন পাবনার নিজ জন্মস্থানে। তিনি শিকড় বিচ্ছিন্ন হন নি। উন্মূল ভাবনা কিংবা শুধুমাত্র ব্যক্তির মননশীল রূপায়ণকেই সাহিত্যের অনিবার্য উচ্চারণ করে তোলেন নি। তিনি অনায়াসে তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে খ্যাত বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে কিংবা অমীয় চক্রবর্তীকে অনুসরণ অনুকরণ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে অত্যন্ত দক্ষ কুশলীর মতো তিনি নিজ জন্মবিন্দুকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁকেই জীবন বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু বানানোরও আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তবে সে সময়ে তাঁর সামনে আদর্শ হিসেবে হয়তো জসীমউদ্দীন ছিলেন। কারণ তার প্রথম কবিতার বই যখন প্রকাশিত হয় তখন জসীম উদ্দীনের ‘রাখালী’, ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তবুও কলকাতার বৈদগ্ধ নাগরিক সমাজে বসবাস করার কারণে তাঁর সামনে তখন অনেক পথ, অনেক ঘাট খোলা। অনেক দিকই অবারিত উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু সেসব কোনো দিকে না গিয়ে বন্দে আলী মিয়া পদ্মা ও পদ্মাতীরের ছোট পরিসরকে কাব্যবন্দনার মূল বিন্দু হিসেবে বেছে নিলেন। এতে বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি কতো বড় কবি হিসেবে স্বীকৃত হলেন তারচে জরুরি আপন আলয়ের ঐতিহ্যকে কাব্যের খুঁটি হিসেবে ব্যবহারের যে আন্তরিক প্রয়াস তিনি দেখালেন তার মূল্যায়ন করা।

কবি বন্দে আলী মিয়া সাহিত্যের যে ধারাকে আঁকড়ে ধরেছেন তা বাংলাসাহিত্যের জগতে নতুন কিছু নয়। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ঐতিহ্য চর্যাপদেরই ধারাবাহিক পথ পরিক্রমা মাত্র। চর্যার কবিরা সাবলীলভাবে পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রণয় ও জীবনের কথা বলেছেন। তারা বলেছেন উঁচু পর্বতের কথা, শবর বালিকার কথা। প্রকাশ করেছেন শবরের প্রমত্ত আবেগের কথা। বৈষ্ণব পদাবলীতেও রয়েছে নদ-নদী অতিক্রমণের চিত্র, নৌকা বাওয়া কিংবা ডোম-ডোমনী এবং হরিণ-হরিণীর প্রণয়ের কথা। এক্ষেত্রে বলা যায়, কবি হিসেবে বন্দে আলী মিয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ধারার নন। বরং আবহমান বাংলার অহংকারকেই তিনি পথের সাথী করেছেন। যদিও এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য পল্লী কবি হিসেবে খ্যাত জসীমউদ্দীন। তিনি কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রাম বাংলার সহজিয়া জীবনদর্শন। গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নাকে তিনি কাব্যাদর্শের মূল কাঠামোর ভিত হিসেবে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতার যেমন বিস্তার রয়েছে তেমিন রয়েছে গভীরতা। কিন্তু বন্দে আলী মিয়ায় আমরা অতোটা গভীরতার সন্ধান পাই না সত্য, তবে তিনি দক্ষ চিত্রকুশলীর মতো অতিসূক্ষ্মতার সঙ্গে তার শৈশবের দেখা পরিবেশ প্রতিবেশকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন দক্ষতার সঙ্গে। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি পরিবেশের খুব ছোটখাট বিষয়াবলীও যে তাঁর নজর এড়িয়ে যায় নি তার প্রমাণ রয়েছে প্রায় প্রতিটি কবিতায়। অধিকাংশ কবিতাই এ উদাহরণের জন্যে উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি যেন এক কুশলী চিত্রকর। অবশ্য বাস্তবেও তিনি একজন ভালো চিত্রশিল্পী ছিলেন। কাব্যের ক্ষেত্রেও তাঁর ছবি আঁকার কুশলতা অনবদ্য। প্রকৃতি ও জীবজগতে পশু, পাখি-প্রাণী, বৃক্ষ একটি যে অন্যটির সঙ্গে নিবিড় সর্ম্পর্কিত তারও চিত্রসফল উপস্থাপনা তার কাব্যে। যেমন:

শুকরেরা আসি কচু খুঁড়ে খায় যবের ক্ষেতের কাছে
বেজীর পালেরা ইঁদুরের সাথে বাসা বেঁধে সেথা আছে
ওত পেতে থেকে পাড়া হতে তারা মুরগীর ছানা ধরে
কেঁচো ঘুগরাও ধরে ধরে খায় যখন উপোস করে।

এছাড়া প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য তিনি ফুটিয়ে তোলেন এভাবে,

এপার হইতে চাহিয়া ওপারে মাঝরাতে মনে হয়
জোসনা সায়রে ময়নামতী সে হেসে খেলে মেতে রয়;
খোঁপায় জ্বলিছে আগুনের ফুল-আঁচলে জোনাকী মেলা
নিশুতি রাতের কুলে বসি আজ খেলিছে বালুর খেলা
চরের ওপাশে বাবলার ঝোপ ছোট ছোট ঝাউ তরু-
দিনের দুপুরে রাখালেরা সেথা চরায়েছে মোষ গরু,
রাতের প্রহরে ডাকিছে ঝিল্লি হাঁকিছে শিয়াল দল
পূবালী বাতাসে হু হু করে হায় কাঁদিতেছে সে কেবল।

বাংলার লোক ঐতিহ্য ধারার কবি জসীমউদ্দীন রবীন্দ্রনাথের স্নেহ, আদর ও উৎসাহ পেয়েছেন। একইভাবে বন্দে আলী মিয়াও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হয়েছেন। পেয়েছেন বিশ্বকবির কাব্যস্বীকৃতি। কবির ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে মন্তব্য করেছেন তা ইতিবাচক ও উৎসাহব্যঞ্জক। বন্দে আলী মিয়া তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘প্রায় মাস দেড়েক পরে সংবাদপত্র পাঠে জানতে পারা গেল রবীন্দ্রনাথ পারস্য থেকে ফিরে এসেছেন। আমার ‘ময়নামতীর চর’ নামক কবিতার বইখানি সেই সময়ে ছাপা হচ্ছিল। বইটা সম্পর্কে একটা অভিমত কবির নিকট থেকে গ্রহণ করবার দুরাশা মনে ছিল। …কাগজের মোড়ক খুলে ‘ময়নামতীর চরের’ ছাপানো ফর্মাগুলো তাঁর হাতে দিলাম। কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথ একের পর একটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। …দুপুরে আহারাদির পরে সুধাকান্ত এলেন রীবন্দ্রনাথের সেই অভিমতটা হাতে নিয়ে। এরই জন্যে প্রত্যাশায় ছিলাম। তিনি লিখেছেন:
‘তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখতে পাওয়া গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা স্পষ্ট-সহজ এবং কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে দেখেছো এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গীতে প্রকাশ করেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলোর যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুন্ঠিত হওনি, তাতে করে কবিতাগুলি আরও সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছো বলে আমি মনে করি।’

রবীন্দ্রনাথের ঐ অভিমতটা ব্লক করে ময়নামতীর চরের সঙ্গে ছেপে দেওয়া হলো। বইখানি প্রকাশিত হতেই সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

রবীন্দ্রনাথের এ অভিমত যে মিথ্যে হয় নি তার প্রমাণ আজও তাকে নিয়ে পঠন-পাঠন, গবেষণা কিংবা তার ওপর সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ। তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত অনেক কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যেতে পারতেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারতেন কাব্য ইতিহাসের অঙ্গন থেকে। কিন্তু তা হয় নি এবং হবারও নয়। স্বকীয়তায় সমুজ্জল থেকে বন্দে আলী মিয়া আজও কবি-গবেষক এবং সাহিত্যবোদ্ধাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছুঁয়ে থাকতে পারছেন এটি কি তার সৃষ্টি ক্ষমতার বিস্তার ও গভীরতা প্রমাণ করে না?

 

সর্বশেষ - শিল্প ও সাহিত্য