২০১৯-এ রাজশাহীতে যা ঘটলো

শাহিনুল আশিক:

আলোচনায় হত্যাকাণ্ড, ঘূর্ণিঝড় ফণী, ডেঙ্গু-

বছরজুড়ে বেশ কিছু আলোচিত-সমালোচিত ঘটনায় শেষ হলো বছরটি। বছরজুড়ে হত্যাকাণ্ড, ঘূর্ণিঝড় ফণী, ডেঙ্গু, কিশোর গ্যাং, ছেলে ধরা, শিক্ষার্থীদের ধান কাটা, জুট মিলে শ্রমিকদের আন্দোলন ইত্যাদি ঘটনা মধ্যে কেটেছে ২০১৯ বছরটি।
এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ফণী, ডেঙ্গু, কিশোর গ্যাং, ছেলে ধরা এই ঘটনাগুলো বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সতর্কতার পরে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীকে হত্যা, শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা এমন ঘটনাও ঘটেছে এই বছরে। ঘটনাগুলোতে মামলা ও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

রাজশাহীর রাজনীতিতে লেগেছে পরিবর্তন। হয়েছে উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচন। সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠত হয়। এতে পরিবর্তন হয়েছে পদের। এছাড়া রাজশাহীতে বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন দলটি। এছাড়া তাদের কেন্দ্রীয় নেতারা এসেছেন, রাজশাহীতে দিয়েছেন বিভিন্ন কর্মসূচিও। সবমিলে রাজনীতির অঙ্গন বেশ শান্ত ছিলো বছরজুড়ে।

রাজশাহীতে প্রকাশিত বেশ কিছু স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে। বছরটিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত ৪ ডিসেম্বর নগরীর দাশপুকুরে আব্দুল মজিদকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় মহনগরীর বহরমপুর এলাকার মৃত আব্দুল গফুরের ছেলে হামিদুর রহমান বাবু ওরফে খামার বাবু, হড়গ্রাম নতুনপাড়া এলাকার হারুনের ছেলে রবিউল ইসলাম (৩৮), চন্দ্রিমা থানার উজিরপুর এলাকার আব্দুস সামাদ (৫০), আবুল কাশেম (৪১ ) ও মকবুল আলীর স্ত্রী আশুরা বেগমকে (৪৮) গ্রেফতার করে পুলিশ।

রাজশাহী মহানগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাত হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ৩০ নভেম্বর নগরীর মালদা কলোনিতে পাওনা টাকা চাওয়ায় রাজন শেখ (২৮) নামে এক দোকানিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় মূলহোতা সোহেলকে আটক করে পুলিশ।

১৩ নভেম্বর যুবলীগ কর্মী সানোয়ার হোসেন রাসেলকে (৩০) ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। নিহতের বড় ভাই বাদী হয়ে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। সেই রাতে সাতজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই ঘটনায় ভাই রাজা আহত হয়েছিলেন।
৪ নভেম্বর নগরীর শেখেরচক এলাকায় বড়ভাইয়ের রডের আঘাতে আহত আশরাফুল হকের (৪০) মৃত্যু হয়। ১৮ আগস্ট পুঠিয়া উপজেলায় ধানের বীজ কেনাবেচার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোহেল রানা (৩০) নামে এক কৃষককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুইজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

৭ আগস্ট কাটাখালী থানার কুখ-ী বাইপাস এলাকায় গরু ব্যবসায়ী জরিপ মৃধাকে (৩৬) হত্যা করা হয়। ১৮ জুলাই পবা উপজেলার কলারটিকর গ্রামে স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যার পর থানায় আত্মসমর্পণ করেছেন স্বামী শরীফুল ইসলাম রেন্টু (৩৫)। ১০ জুলাই গোদাগাড়ীতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে মা সেলিনা বেগমকে (৫০) হত্যার দায় স্বীকার করেছে মাদকাসক্ত ছেলে সালেক আহমেদ।

২৬ জুন তানোরে আম বিক্রির দরদামকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি সুজন আলী (৩২) খুন হন।
এই বছরের ঘটেছে কিছু ধর্ষণের ঘটনাও। এর মধ্যে ৩১ অক্টোবর চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ২৫ বছরের এক তরুণীকে ছাত্রাবাসে আটকে রেখে রাতভর দলগতধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার আগের দিন পবা উপজেলার দামকুড়া থানার পুরাতন কসবা গ্রামে চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে স্কুলটির এক শিক্ষককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণের অভিযােগে রাজশাহীর পবার হরিপুর ইউনিয়নের বেড়পাড়া গ্রাম থেকে পাঁচ রাখালকে আটক করে পুলিশ।

গ্রেফতার রাখালরা হলেন, গরুর রাখাল আসাদুল ইসলাম (২৭), সাকিম (২৬), দুখু (৩৫), সজিব (২৪) এবং বাইরুল (৩৩)। ২০ জুন ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ট্রেন সিল্কসিটি এক্সপ্রেসের টয়লেটের মধ্যে এক কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ট্রেনযাত্রীরা ওই বখাটেকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। ১৫ জুন বাগমারায় এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সড়ক দুর্ঘটনার দিকে দেখা যায় প্রায় ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর গোদাগাড়ীতে বাসচাপায় ফাহিমের (৬) মৃত্যু হয়। তার দুদিন আগে পুঠিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় আবু সালেকের (২৬) মৃত্যু হয়। তিনি রেলওয়ে কর্মকর্তা ছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর বাগমারায় যাত্রীবাহী দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আবু বাক্কারের (৬০) মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দুই বাসের অন্তত ১৫ যাত্রী আহত হয়েছেন। বাগমারা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রইস উদ্দিন নিশ্চিত করেছেন। একই দিনে মোহনপুরের মৌগাছিতে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় সিফাত হোসেন (২০) ও খায়ের আলীর (৫০) মৃত্যু হয়। তার আগের দিন বাঘায় ট্রাক্টর উল্টে সুইট আহম্মেদ (২০) নামে এক চালকের মৃত্যু হয়েছে।

১২ ডিসেম্বর নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালিতে বাস-মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘষে পাপুল হোসেন (৩২) ও আব্দুল হাদীর মৃত্যু হয়। ১০ ডিসেম্বর পুঠিয়ায় ট্রাকচাপায় আবদুল বারিক (৩২) নামে এক ভ্যানচালকের মৃত্যু হয়। ৩০ নভেম্বর পুঠিয়ায় ট্রাকের ধাক্কায় কুতুব আলীর (৫৫) মৃত্যু হয়। ২১ অক্টোবর রাজশাহীতে ট্রেনে কাটা পড়ে একই সঙ্গে বাবা ও মেয়ের মৃত্যু হয়। নগরীর ধরমপুর এলাকার মৃত জাহাঙ্গীর আলম মাখনের ছেলে কামরুজ্জামান রুবেল (৩০) ও তার মেয়ে রুবাইয়া খাতুন (৩)। জিআরপি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান বলে এটি দুর্ঘটনা বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শিক্ষাঙ্গনে গেল বছর:

শিক্ষক নির্যাতন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ, হত্যা, আত্মহত্যারে মধ্যে শেষ হলো ২০১৯ সাল। বছর জুড়ে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে রাজশাহীতে। তবে এই ঘটনাগুলোতে বেশ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষাঙ্গনে। হয়েছে আন্দোলন, মিছিল ও বিক্ষোভের মত ঘটনাও। আহত হয়েছে শিক্ষার্থীরা।

দুই নভেম্বর দুপুরে রাজশাহী রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিউদ্দিন আহম্মেদকে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এনিয়ে সাত জনের নাম উল্লেখ্য করে ৫০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে অধ্যক্ষ। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। এনিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।

১০ এপ্রিল ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় রাজশাহী ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ছাত্রদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় ১১ জন শিক্ষার্থীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’ সেই সঙ্গে ডিপ্লোমা কোর্স জানুয়ারি-২০১৯ এর অবশিষ্ট মৌখিক পরীক্ষাসমূহ এবং বিএসসিসহ ডিপ্লোমা কোর্সের সকল বর্ষের ক্লাসসমূহ স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।’

কলেজ ছাত্রকে হত্যা:

রাজশাহীতে সারা বছরে পাঁচ শিক্ষার্থী খুন হয়েছে। ২৪ নভেম্বর গোদাগাড়ীতে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে কলেজছাত্র মো. শান্তকে ছুরিকাঘাত করে হত্য করা হয়। এই ঘটনায় চারজনকে আসামি করে মামলা করা হয়।

১৩ নভেম্বর নগরীর পবা নতুনপাড়া এলাকায় ছুরিকাঘাতে আবদুল্লাহ আল ফাহিম (১৮) নামে এক কলেজছাত্র নিহত হন। তিনি মহানগরীর বরেন্দ্র কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। এই ঘটনার পরে সৈকত নামের একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৬ সেপ্টেম্বর নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় ছুরিকাঘাতে ইমন হোসেন নামের এক স্কুলছাত্রকে হত্যা করা হয়।

এই ঘটনায় নিহত ইমন হোসেনের বাবা আব্দুস সালাম বাদী হয়ে চারজনকে আসামি করে মামলা করেন। এরা হলেন- ইমনের সহপাঠী হৃদয়, ইমন, অন্তর ও হানিফ।

গত ৬ আগস্ট রাজশাহী সিটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন আশারিয়া রাব্বিকে ছুড়িকাঘাত করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মো. রনক নামে এক যুবলীগ কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

১৬ মে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সরমংলা খাড়ির (জলাশয়) পাশের একটি গাছে থেকে এক কিশোরের (১৮) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেই স্থানীয় এক কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো বলে পরিবারের দাবি।

আত্মহত্যা:

২০১৯ সালে ২জন শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ২৯ জুন নগরীর দেবিশিংপাড়ার এসএস ছাত্রাবাস থেকে এজাজ আহমেদ আকিবের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

১০ এপ্রিল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ইব্রাহিম হোসেন (১৮) নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর আত্মহত্যা করে। ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় আত্মহত্যা করে স্কুলছাত্রী সুমাইয়া আক্তার বর্ষা। এনিয়ে মামলা চলছে আদালতে। এছাড়া বেশ কিছু আত্মহত্যার ঘটাও রয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মৃত্যু:

সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। রাজশাহীর পুঠিয়ায় ট্রাকচাপায় সিরাজুল হক নামে এক কলেজ শিক্ষক নিহত হন। তিনি ইসলামী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ৯ জুলাই পবা উপজেলায় ট্রাকচাপায় আবদুল হালিম (৩২) নামে এক স্কুল শিক্ষক নিহত হন। হালিম পবা উপজেলার কশবা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

১১ নভেম্বর তার পরের দিনে দুর্গাপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা আলতাফ হোসেনের (২০) মৃত্যু হয়েছে। ১৪ অক্টোবর দুর্গাপুর উপজেলায় মাহেন্দ্রার (থ্রি হুইলার) ধাক্কায় সোহেল ইসলাম (৯) নামে এক স্কুলছাত্র নিহত হয়েছে।

এর মধ্যে ৮ সেপ্টেম্বর বাগমারায় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ভটভটি উল্টে আসাদুজ্জামান আসাদ (১৭) নামে এক মাদ্রাসাছাত্র নিহত হন। ২০ জুলাই চারঘাটে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় মীম খাতুন (৮) নামের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ২৩ জুন বাঘায় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় মিজানুর রহমান নামে ষষ্ঠ শ্রেণির এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়। তিনি চন্ডিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। ২ মে নগরের বর্ণালির মোড়ে ট্রেনে কাটা পড়ে কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়। ২১ এপ্রিল বাঘায় পদ্মা নদীতে গোসল করতে নেমে তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ ভানুকর গ্রামের জিল্লুর রহমানের মেয়ে ইশা (১০) ও জিম (১৭) এবং জিল্লুরের চাচাতো ভাই শহীদুল ইসলামের মেয়ে শিপ্রা (১২)। এর মধ্যে জিম মীরগঞ্জ কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী, শিপ্রা মীরগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ও এশা খাতুন বাঘা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ২০ মার্চ গোদাগাড়ীতে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় সাদিয়া আক্তার নামে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়।

 

স/আ