প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, রাষ্ট্র, জনগণের প্রত্যাশা, বিরোধী দলের অপরাজনীতি

আগামী মাসের ৭ই এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের দিন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতকে নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা, সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, তিস্তা চুক্তি ছাড়া অন্যকোন চুক্তি জনগণ মানবে না। বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অবশ্য আরেকধাপ এগিয়ে বলেছেন, জনগণ যেকোন ভাবে এসব চুক্তি, সমঝোতা মোকাবেলা করবে। বস্তুত নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলে বাংলাদেশে ভারত বিরোধীতার রাজনীতি তুঙ্গে উঠে। বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যায়, মসজিদ, মন্দির হয়ে যায়, মুসলিম নারীর সিঁথিতে সিঁদুর দেখতে পান একটি বিশেষ মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতারা। এবার অবশ্য এই বিরোধীতার রাজনীতি একটু আগেভাগে শুরু হয়েছে।

 

ধারণা করা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগামী ৭ই এপ্রিল ভারত সফরের আগে তা আরও বাড়তে থাকবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিএনপি ও তার মিত্রশক্তি ভারত বিরোধীতাটাকে তাদের পরিকল্পিত প্রচার হিসাবে ব্যবহার করছে। এ সফর সফল হলে বিএনপি ও তাদের মিত্রশক্তিরা বলবেন, শেখ হাসিনা ভারতের সাথে দেশ বিক্রির চুক্তি করে এসেছেন। আর সিস্টেমেটিক জটিলতার কারণে দু’একটি বিষয় যদি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অপেক্ষমান থাকে তাহলে বিরোধীদল বলবে সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভাল শুভ নয়। অবশ্য আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সেতু মন্ত্রী ওবাইদুল কাদের ইতিমধ্যে বলেছেন, ভারত বা অন্য কারো সঙ্গেই বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন চুক্তি হবে না। একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিক হিসাবে তিনি একথার মাধ্যমে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও সরকারের মানসিক অবস্থানকে পরিষ্কার করেছেন এটা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। বিরোধীদলের ভারতকে নিয়ে এই অপরাজনীতির সুস্পষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং ভারতের সঙ্গে একটি স্থায়ী বিরোধ সৃষ্টি করার চলমান প্রক্রিয়া। কেননা গত ১০ বছরে বিএনপি ও তাদের মিত্রশক্তিরা রাজনৈতিক অঙ্গন অথবা রাজপথ কোনখানেই তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। নিজেদের ভুল সিদ্ধান্ত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে বিএনপির শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থান সহ নানান ব্যর্থতার কারণে বিএনপি যেমন এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেনতায় বিশ্বাসী বৃহত্তর গণমানুষের আস্থা হারিয়েছে তেমনি দলীয় ভাবে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা, জামায়াত প্রশ্নে কোন সঠিক অবস্থান পরিষ্কার না করতে পারার কারণে বিএনপি গভীর হতাশায় নিমজ্জিত। একসময় তারা ক্ষমতায় না যাওয়ার কারণ হিসাবে বিচারপ্রতি খাইরুল হকের রায় এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে অভিযুক্ত করে। কিন্তু বিএনপি নিজেদের রাজনৈতিক অক্ষমতা থেকে আত্মসমালোচনা করেনি আত্মশুদ্ধি তো সুদূর পরাহত ব্যাপার। সামনে ২০১৮ সালের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন তো বিএনপি’র এখন প্রধান ইস্যু হচ্ছে ভারতের বিরোধীতা করা।

 

বিএনপি মনে করে যে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি দূরত্ব তৈরী করতে পারলে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের হয়তো ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হবে। যে কারণে বিএনপি’র সামনে ভারত বিরোধীতা এখন প্রধান ইস্যু এবং বিএনপি নেতারা খুঁজে খুঁজে ভারত বিরোধীতাকারী বিষয়গুলিকেই সামনে আনছেন। যাতে বাংলাদেশের প্রতি ভারত অখুশি হয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে চীন থেকে সংগ্রহ করা দু’টি সাবমেরিন যুক্ত হয়। মিয়ানমারের দখল থেকে প্রাপ্ত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিশাল জলরাশি ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য যে সাবমেরিনগুলি আবশ্যক ছিল এব্যাপারে বিএনপির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং চীন থেকে ক্রয় করা হয়েছে বলে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের প্রতি অখুশি এ বিষয়টির প্রচার চালাতেই বিএনপি নেতাদের বেশী তৎপর দেখা গেছে। তারা একবারও বলেনি বাংলাদেশের সামরিক শক্তি অর্জন পাকিস্তানের জন্য গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। বিএনপির এসব বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে বর্তমান আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে ভারতের আস্থাহীনতার ক্ষেত্র তৈরী। কেননা ভারত আস্থাহীন হলে আগামী নির্বাচনে হয়তো বিএনপি ক্ষমতা যেতে পারবে এবিষয়টি তারা এখন উপলদ্ধি করতে পেরেছে। কেননা আন্তর্জাতিক বিশ্বে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় তারা বহির্বিশ্বে যে ক্রমশ বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে এমতাবস্থায় যদি কোন ভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আস্থাভাজন হওয়া যায় তাহলে হয়তো বিএনপি’র রাজনৈতিক পালে হাওয়া লাগতে পারে। এজন্যই তারা শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের দূরত্ব তৈরী করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধতা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ভূখন্ডটিকে যেমন একদিকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র তেমনি অপরপক্ষে বাংলাদেশের বহির্বিশ্বে মিত্রদের বিভ্রান্ত করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র দুর্বল করা এবং ভারত বিরোধী শক্তিগুলোকে বিএনপির মিত্রশক্তি হিসাবে কাজে লাগানোর চলমান প্রক্রিয়া।

 

প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে মৌলবাদীদের বিকাশের পিছনে ’৭৫ পরবর্তী পরিবেশই দায়ী ছিল। কেননা বঙ্গবন্ধুকে তীরহিত করতে একদা জাসদ যে কাজ শুরু করেছিল তার ধারাবাহিকতা জোরালো হয় ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর এবং এরপরেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিকল্পনা করে শত্র“তামূলক দৃষ্টিভঙ্গির রাষ্ট্রীয় প্রসার ঘটানো হয়। পাকিস্তানী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য অঞ্চলের জেলাগুলোতে পরিকল্পিত ভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম এবং মদদ দেয়া হয় এবং সেভেন সিষ্টারসে অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূখন্ডকে একটি রুট হিসাবে ব্যবহারের অপরাজনীতি শুরু হয়। বিএনপি এবং তার মিত্ররা ইন্দিরা-মুজিব ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তিকে বরাবর গোলামী চুক্তি হিসেবে প্রচার করেছিল। অথচ সেই চুক্তিফলেই এতবছর পরে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশ তাদের মূল ভূখন্ডের সাথে ১০ হাজার একর জমি বেশি পেয়েছে। অথচ এতদিন এই চুক্তিকে দেশ বিক্রি ও গোলামী চুক্তি হিসাবে অপপ্রচার চালিয়ে এসেছিল বিএনপি ও তার মিত্রশক্তিরা। বস্তুত আমাদের দেশের রাজনীতিতে ভারত বিরোধীতা শুধুই নিজেদের ক্ষমতায় নেয়ার জন্য। তাতে দেশের যতবড়ই ক্ষতি হোক সে ব্যাপারে বিএনপি ও তাদের মিত্রশক্তির কখনই বোধদ্বয় দেখা যায়নি। ভারতের যেকোন অনায্য আচারণের বিরুদ্ধে অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনা থাকাই স্বাভাবিক

 

। তিস্তার পানি দরকার এটি কিন্তু বিএনপি’র একার দাবী নয়, দেশের সমগ্র জনগণের সঙ্গে শেখ হাসিনারও। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ দাবীর পক্ষে আছেন বলেই মনমোহন সিংয়ের সর্বশেষ সফরে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কোন উল্লেখ না থাকায় তিনি ট্রানজিট চুক্তিতে স্বাক্ষর দেননি। যে ঘটনায় ভারতের অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ইহাই ছিল আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। বাংলাদেশের স্বার্থ প্রথম ও প্রধান স্বার্থ এটি নিশ্চয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাতে হবে না। তিস্তা চুক্তির বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকায় আছে এবং সেটি প্রণয়নে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা দেশবাসী অবগত। কিন্তু ভারতের কেন্দ্র এবং রাজ্যের রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে তিস্তাচুক্তি সম্পাদন না হওয়াটা আমাদের জন্য হতাশার। আমরা আশাকরি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ছিটমহলের মত তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের নায্য দাবী মেনে নেবে। রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ সেই চেষ্টা করছে, চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কেউ যদি নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় বলেন যে, তিস্তা চুক্তি না হলে অন্যচুক্তি হবে না সেটা নিজের নাক কেটে ঠিক অপরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতই বিষয় হবে।

 

আমরা মনে করি তিস্তা চুক্তি যেমন প্রয়োজন ভারতের সাথে আমাদের অন্যবিষয়গুলির চুক্তি ঠিক সমান প্রয়োজন। তবে তিস্তার কারণে অন্য চুক্তি সম্পাদন করা যাবে না ইহা কোন ভাবেই সঠিক নয়। এমুহুর্তে এশিয়া অঞ্চলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ঐক্য আশু দরকার। এসব বিষয়ও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমাদেরকে ভাবতে হবে সরকার নাগরিকের ভাবনা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, গড়ে উঠবে জঙ্গি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আঞ্চলিক ঐক্য এশিয়া অঞ্চল সুখি সমৃদ্ধ হবে এই প্রত্যাশায় করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল হোক, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ঐক্যের ধারাবাহিকতা নিশছিদ্র ও নিরাপদ থাকুক অবিরাম, অবিরত।

ওয়ালিদ আহমেদ কমল
সাবেক সহ-সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ