শুক্রবার , ৫ জুলাই ২০২৪ | ২৪শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রণয়, কবি ও কবিতা | অনুপম হাসান

Paris
জুলাই ৫, ২০২৪ ৪:১৮ অপরাহ্ণ

প্রেম মানবজীবনের এক অনন্য অনিবার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের এই অবিচ্ছেদ্য অংশের সাথে কবি ও কবিতার সম্পর্ক নিবিড়, নিগূঢ়, রহস্যঘন; কবিতায় প্রেম প্রায়শই থাকে, কখনো বা তা অপরিহার্য অনুষঙ্গ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কবি ও কবিতায় দুটো ব্যাপার প্রায় অবিচ্ছেদ্য : এক. প্রকৃতি, দুই. প্রণয় বা প্রেম। এমন কোনো কবির বোধহয় সন্ধান পাওয়া যাবে না, যাঁর কবিতায় প্রণয় ও প্রকৃতি প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। কথাবাহুল্য, প্রকৃতিও কবিতায় আসে প্রণয়ের হাত ধরেই; অর্থাৎ প্রকৃতি বা নিসর্গের সাথে কবির মানসিক যে সম্পর্ক-সেতু নির্মিত হয়, তা অন্যার্থে প্রকৃতিপ্রেম হিসেবেই পরিচিত। প্রকৃতির সাথে কবির যে প্রেম, সেখানে দৈহিক কামনা-বাসনা থাকে না, থাকার সুযোগও নেই; থাকে অনাবিল সৌন্দর্যচেতনা। অন্যদিকে মানবিক প্রেমের ক্ষেত্রে কামনা-বাসনার সম্পর্ক থাকে বা থাকার সম্ভাবনা প্রচুর, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে মানবিক প্রণয়ও নিছক ভালো লাগা কিংবা সৌন্দর্যবোধ থেকেও উৎপন্ন হতে পারে, কখনো কখনো তা হয়ও; তবে সেখানে পারস্পরিক বিপরীত লিঙ্গের সহজাত আকর্ষণে দৈহিক বিষয়টি আসা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়।

গীতিকবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ব্যক্তির অন্তর্গত চিন্তাচেতনা, ভাব-কল্পনা ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করা। ব্যক্তির চেতনায় প্রেম এক অপরিহার্য অংশ; বলা হয়— মানবজীবনকে প্রধান দুইভাগে ভাগ করলে, তার প্রধান এক ভাগেই থাকে প্রণয় তথা কামনা-বাসনা। কথিত আছে, কবিদের কামনা-বাসনা সাধারণের চেয়ে খানিকটা বেশিই থাকে; এজন্যই দেখা যায়— যে বয়সে সাধারণের কামচেতনা তিরোহিত হয়, তখনো কবিরা সক্রিয় থাকেন। বিগত যৌবনেও কবির ভাবনা-জগৎ প্রণয়-কামনা দ্বারা সমাচ্ছন্ন থাকে; সেটা থাকেই বলেই কবিতা লিখতে পারেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কামচেতনাহীন বা ক্লীব কখনো শিল্পী হয় না; অন্তত এখন পর্যন্ত আমাদের সামনে এ জাতীয় কোনো শিল্পীর দৃষ্টান্ত নেই। সুতরাং শিল্পীর মানস-রঙে রঞ্জিত শিল্পকর্ম— তা কবিতাই হোক বা গল্প-উপন্যাসই হোক, সেখানে অনিবার্যভাবেই থাকে কামনা-বাসনার উপস্থিতি। শিল্পে কামবাসনার স্থূল উপস্থিতি কাম্য নয়। কামনা-বাসনার শিল্পিত রূপই প্রেম বা প্রণয়। কবি স্থূল কামনা-বাসনাকে শৈল্পিক কল্পনার রঙে রঞ্জিত করেন বলেই তা প্রণয়, অন্যথায় তা নিছক দেহবৃত্তি বা পর্নোগ্রাফি। কবিতা পর্নোগ্রাফি নয়, উচ্চমার্গের শিল্প।

বাংলা কবিতার ইতিহাস তো রবীন্দ্রনাথের কাল পর্যন্ত প্রেমে দৈহিক অনুষঙ্গ অচ্ছ্যুত হিসেবেই গণ্য ছিল। রবীন্দ্র-বলয়ের রোমান্টিক প্রণয়ের কপট মুখোশ সরিয়ে তিরিশের দশকের কবিদের পথ নির্মাণ করেছিলেন মোহিতলাল মজুমদার; তিনি কবিতায় প্রগাঢ় মগ্নতায় দেহবাদী চেতনা ও কামজ বাসনার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন প্রথম, তারপর তিরিশের কবিতায় দেহজ বাসনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত পাঁচ কবি। মূলত মোহিতলাল মজুমদারের অকপট দেহজ বাসনার প্রকাশই তিরিশের কবিদের সাহসী করে তুলেছিল; তাঁরাও প্রণয়ে দৈহিক কামনা-বাসনার উপস্থাপন করেছিলেন। প্রসঙ্গত একথা স্মরণীয়, আধুনিক মানুষ সব ধরনের ভণ্ডামি-কপটতা কিংবা রহস্যের আড়াল সরিয়ে যখন জীবনকে, জাগতিক বাস্তবতাকে কবিতায় তুলে ধরতে চেয়েছে— তখন মানবিক প্রণয়-বাসনায় কোনোভাবেই দেহকে তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন নি, করেনও নি।

আধুনিক কবিদের কবিতায় প্রণয় আছে, প্রণয়ে দেহ আছে; আছে দেহজাত কামনা-বাসনাও। কারণ, আধুনিক কবি জীবনকে যথাযথ বাস্তবতার যৌক্তিক নিরিখে নির্মোহ ভঙ্গিতে উপস্থাপনে প্রয়াসী। প্রণয়ে দেহ থাকবে, থাকাটাও স্বাভাবিক; প্রণয়-বাসনার বহিঃপ্রকাশ যখন অশ্লীল কামচেতনায় নিমজ্জিত হয়, তখন তা কতখানি কবিতা হয়— সেটা নির্ভর করে পাঠকের রুচির উপর, সৌন্দর্য আস্বাদনের শৈল্পিক প্রজ্ঞার উপর।

প্রচ্ছদ রাজিব রায়

সর্বশেষ - শিল্প ও সাহিত্য