পুলিশ সুপার বিদায়ী সংবর্ধনা: আবেগ প্রবন নওগাঁবাসী

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ:
পুলিশ মানে আতঙ্ক আর ভয়। পুলিশ পারেনা এমন কোন কাজ নেই। কতিপয় কিছু পুলিশ সদস্যের কারণে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। মানুষ তাদেরকে ঘৃনার চোখে দেখেন। আবার এমন কিছু পুলিশের সদস্য আছেন, যাদের কাজকর্ম দেখলে মাথা শ্রদ্ধায় নিচু হয়ে যায়। আর তাদের কারণে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কার্যক্রম সঠিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের হাতের ছোঁয়ায় বদল হচ্ছে অনেক জীবন। মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারছেন। আলাদিনের চেরাগের মতোই যেন স্বপ্নের মতো সবকিছুর পরিবর্তন।

আর নওগাঁ জেলাকে আধুনিকতার ছোয়ায় পরিবর্তন করে দিয়েছেন এমনই এক পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক বিপিএম, পিপিএম। সম্প্রতি তাকে পদোন্নতির জন্য নওগাঁ থেকে নতুন কর্মস্থলে চলে যেতে হচ্ছে। বদলির আদেশপ্রাপ্ত হন চলতি বছরের ২৬ জুলাই। গত ২০১৫ সালের ৩ জুন তিনি নওগাঁর পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেছিলেন।

তাঁর বদলির খবরে ভারাক্রান্ত সহকর্মী, অধীনস্থ সদস্যগণসহ নওগাঁবাসী। তবুও সরকারি চাকরি সুবাদে বদলি হতে হচ্ছে। আর এ কারণে জেলার পুলিশ বিভাগসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছেন। প্রায় তিনশতাধিক ক্রেস্ট ও ফুলেল শুভেচ্ছা পেয়েছেন। বিভিন্ন কর্মকান্ডের স্মৃতিচারণ করছে মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে। তিনি চলে যাচ্ছেন। কিন্তু রেখে গেলেন নানা স্মৃতি। পাশাপাশি নওগাঁর মানুষকে কঠিন মায়ার জালে আবদ্ধ করেছেন।

তাঁর দুই বছরের কার্যকালে জেলার উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডের মধ্যে- নওগাঁ পুলিশ লাইনস্ এর বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ, দৃষ্টিনন্দন দুটি গেট তৈরি, পুলিশ লাইনস্ মাঠের চতুর্দিকে পাকারাস্তা নির্মাণ, সম্পূর্ণ পুলিশ লাইন্সকে সিসি টিভির আওতাভুক্ত করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা, পুলিশ লাইন্স ব্যারাকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নিহত পুলিশ সুপার নজমুল হক এর নামে নামকরণ, চারতলা বিশিষ্ট নতুন মহিলা ব্যারাকের নির্মাণ কাজ শুরু, মোটরসাইকেল গ্যারেজ নির্মাণ, নওগাঁ পুলিশ লাইনস গেটের পাশে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি এটিম বুথ স্থাপন, পুলিশ লাইন্সে এয়ার কন্ডিশনার (এসি) আধুনিক মসজিদ ও অজুখানা নির্মাণ। এছাড়াও মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য পর্দাঘেরা আলাদা একটি কক্ষ। এছাড়াও জেলার ১১টি থানায় স্যালুটিং মঞ্চ তৈরী ও বৃক্ষ রোপন করেছেন।

পুলিশ সুপার হিসেবে নওগাঁ যোগদানের পর থেকে অদম্য ছুটে চলেছেন জেলার প্রত্যান্ত অঞ্চলে। সাধারন মানুষদের সাথে তিনি মিশেছেন। তাদের ভাললাগা ও খারাপ লাগা কথা শুনেছেন। তাদেরকে আপন করে নিয়েছেন। সাধারন মানুষ যে কোন প্রয়োজনে যে কোন সময়ে কোন বাঁধা ছাড়াই তাঁর সাথে দেখা ও কথা বলেছেন। তবে তিনি সবসময় পেশাদারিত্বে কাজের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছিলেন জিরো টলারেন্স। অনেক মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পন করেছেন। যাদের মামলা চলমান আছে তাদেরকে অতি শিগগিরই মামলা শেষ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশ্বাস দিয়েছেন। অসহায়দের বুকে টেনে নিয়েছেন। তাঁর বিদায় নিয়ে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন ছবি ও কার্যক্রম গত কয়েকদিন থেকে ভাইরাল হয়ে আছে।

ধামইরহাট উপজেলার জাহানপুর ইউনিয়নের বিকন্দখাস গ্রামের দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক। তিনি বলেন, তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে ও মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে মেহেদী হাসান (১৯) ডিগ্রীতে পড়ছে। চলতি বছরে মে মাসে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হলে ছেলেকে নিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে যান। তার অসহায়ত্বে কথা বলে ছেলের একটা চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন। বিভিন্ন পরীক্ষায় মেহেদী উত্তীর্ন হলে চাকুরি হয়। বর্তমানে সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজে প্রশিক্ষণ চলছে।

নওগাঁর একটি সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদের সাধারন সম্পাদক এম.এম রাসেল বলেন, পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যাপক অবদান রেখেছেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকি। যে কোন প্রয়োজনে তাঁকে আমরা পাশে পেয়েছি। তিনি আমাদেরকে উজ্জিবিত করেছে। আমরা নওগাঁরবাসী তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

সদর উপজেলার আশরাফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ যে খারাপ হয়না। তাকে না দেখলে বুঝা যেতনা। তিনি খারাপদের কাছে হয়তো খারাপ ছিলেন। কিন্তু সাধারনদের কাছে ছিলেন অসাধারন। যা বলে প্রকাশ করার মতো না। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে এরকম এক কর্মকতা থাকা বা পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। তাঁর বিদায় খুবই কষ্টদায়ক এবং বেদনাময়। ‘তিনি কাঁদলেন, কাঁদিয়ে গেলেন নওগাঁবাসীকে’।
বিদ্যুৎ বিপ্লব নাম অপর একজন ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, স্যার অনেকে অর্জন করে টাকা পয়সা। আর আপনি যা অর্জন করেছেন তা হলো মানুষের ভালোবাসা। যা সারাজীবন আপনার অলংকার।

মোজাম্মেল হক ১৮তম বিসিএস পরীক্ষায় উর্ত্তীন হয়ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ পান। পর্যায় ক্রমে ২০১০ সালে ২০শে অক্টোবর তিনি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং জয়পুরহাট জেলায় যোগদান করেন।

তিনি ১৯৬৮ সালে ১৫ই জানুয়ারী পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া থানাধীন কাশীপুর গ্রামে নানার বাড়ীতে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবাবে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল জব্বার বিশ্বাস এবং মাতার নাম মোমেনা বেগম। ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী সুলতানা হক (কণা) একজন গৃহিনী, দুই কন্যা এবং এক পুত্র সন্তানের জনক।

বিদায়ী পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক বলেন, কাগজে লিখা নাম ছিড়ে যাবে। পাথরে লিখা নাম ক্ষয়ে যাবে। কিন্তু হৃদয়ে লিখা নাম চিরদিন রয়ে যাবে। নওগাঁবাসীদের ভালবাসা আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় গেঁথে থাকবে। আমি কৃতজ্ঞ নওগাঁবাসীর প্রতি।

স/অ