পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর হয়েও নিজ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি। ’ শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণের উদ্দেশ্য গীতার জ্ঞানযোগ সাত-আট শ্লোকে রয়েছে। যখনই পৃথিবীতে অধর্মের প্রাদুর্ভাবে দুরাচারীর অত্যাচার ও নিপীড়নে ভক্ত ও সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য কৃপা করে ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর অবতার রূপ নিয়ে থাকেন। তখন তিনি ষড়গুণ যথা—ঐশ্বর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্য সম্পন্ন ‘পূর্ণাবতাররূপে’ প্রকাশিত হন।

দ্বাপরযুগে ভাদ্র মাসে রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে আবির্ভূত, তাই সনাতন ধর্মের মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। তখন ভারতবর্ষে এক অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর জন্মলীলাই জন্মাষ্টমী। তিনিই পুরুষোত্তম। সাধারণত পুরুষোত্তম শব্দের অর্থ হলো পুরুষের মধ্যে যিনি উত্তম। পুরুষোত্তম তত্ত্বে তিন পুরুষের কথা বলা হয়েছে—ক্ষর পুরুষ, অক্ষর পুরুষ ও উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, ‘ক্ষর পুরুষ সর্বভূত, অক্ষর কূটস্থ পুরুষ এবং আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর হতেও উত্তম, এই জন্যই আমি পুরুষোত্তম। ’

অনেকে বলেন, ‘অক্ষর বলতে বোঝায় অব্যক্ত প্রকৃতি বা মায়া, আর ক্ষর বলতে বোঝায় ব্যক্ত জগৎ। আর ব্যক্ত সৃষ্টি ও অব্যক্ত প্রকৃতির অতীত যে ব্রহ্ম, তিনিই পুরুষোত্তম। ’ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘এখানে ক্ষর বলতে বোঝায়—প্রকৃতি এবং অক্ষর বলতে বোঝায় পুরুষ বা জীবাত্মা এবং উভয়ের অতীত পরব্রহ্মই পুরুষোত্তম। ’ আবার কেউ বলেন, ‘অবিদ্যার বহু-মূর্তিতে অবস্থিত যে চৈতন্য, তিনিই ক্ষর বা জীব, মায়ার এক মূর্তিতে অবস্থিত যে চৈতন্য, তিনি অক্ষর ঈশ্বর এবং মায়াতীত যিনি, তিনি পরমব্রহ্ম পুরুষোত্তম। ’

পণ্ডিত শ্রীঅরবিন্দু পুরুষোত্তম শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘ক্ষর হচ্ছে সচল পরিণাম—আত্মার বহুভূত বহুরূপে যে পরিণাম, তাকেই ক্ষর পুরুষ বলা হচ্ছে। এখানে পুরুষ বলতে ভগবানের বহুরূপ  (Multiplicity of the Divine Being) বুঝিয়েছেন—পুরুষ এই প্রকৃতি থেকে আলাদা নয়, প্রকৃতির অন্তর্গত। অক্ষর হচ্ছে অচল, অপরিণামী, নীরব, নিষ্ক্রিয় পুরুষ—এটা ভগবানের একরূপ (The  Unity of the Divine Being)

, প্রকৃতির সাক্ষী; কিন্তু প্রকৃতি ও তার কাজ থেকে এই পুরুষ মুক্ত। পরমেশ্বর, পরব্রহ্ম, পরম পুরুষই উত্তম, পরিণামী বহুত্ব ও অপরিণামী একত্ব এই দুই-ই উত্তমের। তাঁর প্রকৃতির, তাঁর শক্তির বিরাট ক্রিয়ার বলে, তাঁর ইচ্ছা ও প্রভাবের বশেই তিনি নিজেকে সংসারে ব্যক্ত করেছেন। আবার আরো মহান নীরবতা ও অচলতার দ্বারা নিজেকে স্বতন্ত্র নির্লিপ্ত রেখেছেন। এর পরও তিনি পুরুষোত্তমরূপে প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র এবং প্রকৃতিতে লিপ্ততা এই দুয়েরই ওপরে। পুরুষোত্তম সম্পর্কে এমন ধারণা উপনিষদে প্রায়ই সূচিত হলেও গীতায়ই এটি স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে এবং তার পর থেকে ভারতীয় ধর্মচিন্তার ওপর এই ধারণা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। যে সর্বোত্তম ভক্তিযোগ অদ্বৈতবাদের কঠিন নিগূঢ় ছাড়িয়ে যেতে চায়, এটি (অর্থাৎ এই পুরুষোত্তমতত্ত্ব) তার ভিত্তি; ভক্তিরসাত্মক পুরাণসমূহের মূলে এই পুরুষোত্তম-বাদ নিহিত রয়েছে। ’ পুরুষোত্তম-বাদ দিয়ে গীতা জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির সমন্বয় সাধন করেছেন। গীতায় পুরুষোত্তম যেমন—সম, শান্ত, নির্গুণ, অনন্ত, অখিলাত্মা, আবার তিনিই গুণ-পালক গুণ-ধারক, প্রকৃতি বা কর্মের প্রেরয়িতা, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোক মহেশ্বর। সুতরাং সর্বভূতাত্মৈক্য-জ্ঞানই পুরুষোত্তম জ্ঞান, সর্বভূতে ভালোবাসাও সর্বশরণে আম্মাসমর্পণই পুরুষোত্তমে ভক্তি এবং সর্বলোকসংগ্রগ্রহার্থ নিষ্কাম কর্ম পুরুষোত্তমেরই কর্ম—এই জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের মিলন দিয়ে আত্মা সর্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যিনি একই কালে অনন্ত আধ্যাত্মিক শান্তি এবং অনন্ত বিশ্বব্যাপী কর্ম উভয়েরই অধীশ্বর সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করেন।

শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, ‘হে ভারত, যিনি মোহমুক্ত হয়ে আমাকে পুরুষোত্তম বলে জানতে পারেন, তিনি সর্বজ্ঞ হন এবং সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন। ’ একই কথা শ্রীকৃষ্ণ অন্যভাবে বলেছেন, ‘আমিই পরতত্ত্ব পুরুষোত্তম। লোকে ক্ষর ও অক্ষর এই দুই পুরুষ প্রথিত আছে। আমি ক্ষরের অতীত এবং কূটস্থ হতেও উত্তম, এই জন্য আমি পুরুষোত্তম বলে খ্যাতি লাভ করেছি। আমাকে পুরুষোত্তমরূপে জানলে আর কিছুই জানার বাকি থাকে না। তখন জীব বুঝতে পারে যে আমি নির্গুণ, আমিই সগুণ, আমিই বিশ্বরূপ, আমিই অবতার, আমিই আত্মা। এই পুরুষোত্তমতত্ত্ব অতি গুহ্য। এটা জানলে জীব কৃতকার্য হয়; সে সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করে। ’

পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধরাধামে আবির্ভূত হয়ে আমাদের জন্য যে দিব্য জীবনের আদর্শ রচনা করে গেছেন, তার মূল রহস্য আত্মস্থ করে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়পরায়ণতায় ও অমৃতলোকের অন্বেষায় শুরু হোক আমাদের অভিযাত্রা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত শ্রীমদ্ভগবদগীতাকে পাথেয় করে ফলের আশা, কর্তৃত্বাভিমান তথা সব মানবীয় সংকীর্ণতাকে পরিহার করে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মানব কল্যাণব্রতে আমাদের অঙ্গীকার হোক ‘শিব জ্ঞানে জীব সেবা’।

পুরুষোত্তমযোগে ভগবান বলছেন জগৎ ব্রহ্মময়। ‘ব্রহ্মৈবেদম্ অমৃতমিদম্’ (মণ্ডকোপনিষদ্, ২/২/১১) অথবা এই ব্যক্ত বিশ্ব ‘অমৃতম্ ব্রহ্ম এব’- অবিনাশী ব্রহ্মই। তাই জগেক ব্রহ্মরূপে দর্শন করিয়া ‘ভূমৈব সুখম্’- ভূমাতেই সুখ, এই বিশ্বাত্মৈক্য বোধে উন্নীত হতে পারলে সংসার বৃক্ষছেদনের প্রয়োজন হয় না, কারণ সবাই ব্রহ্মময়।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম
দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ