পাহাড়ধসে ব্যবসায় ধস, প্রতিদিন ৩ কোটি টাকা করে গচ্চা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: রাঙামাটি শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপা বাজারের উত্তর দিকের মাথায় কাপ্তাই লেক। ভরা বর্ষায় লেকটি পানিতে থই থই। লেকের সমতা ঘাটে আজ বৃহস্পতিবার সকালে অনেক নৌকা ছিল। কিছু নৌকায় পণ্য তোলা হচ্ছিল। সেখানে এক চায়ের দোকানে বসে ছিলেন নৌযানের কয়েকজন মালিক। তাঁদের বেশির ভাগেরই নৌকা ঘাটে বাঁধা। যাত্রী নেই, পণ্য বয়ে নেওয়ার তাড়া নেই। অথচ এ সময় তাঁদের ব্যস্ত থাকার কথা।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, পাহাড়ধসের ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।

টুটুল চাকমা নামের এক নৌযানমালিক বলেন, ‘আগে সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন ভাড়া পাইতাম। এখন দুদিন পাওয়াই মুশকিল। গাছের ব্যবসা বন্ধ। রাস্তার জন্য গাছ বাইরে যেতে পারে না। ফসলও আসে না। ব্যবসা বলতে কিচ্ছু নাই।’

এ ঘাট থেকে চলে উপজাতীয় টেম্পো বোট মালিক সমিতির ৬০টির মতো নৌকা। সমিতির সহসভাপতি পূর্ণাঙ্গ চাকমা বললেন, এখন কষ্টেসৃষ্টে এক-দুটি ট্রিপ পাওয়া গেলেও খালি তেলের খরচ ওঠে। আগে আড়াই হাজার টাকার নিচে ট্রিপ নিতাম না। এখন দেড় হাজার হলেই যাই।

এখানে একাধিক মালিক তাঁদের নৌকা বন্ধ করে দিয়েছেন। নৌকায় থাকা এক চালক জ্যোতির্ময় চাকমার কথা, ‘সপ্তাহে সাড়ে তিন হাজার টাকা পাইতাম। এখন পাই ৮০০ টাকা। কীভাবে আমার পরিবার চলে, বলেন?’

লেকপাড়ের শহর রাঙামাটিতে ব্যবসার অন্যতম অনুষঙ্গ নৌযান। পর্যটকদের নিয়ে ঘোরাঘুরিতেই কেবল নৌযানের ব্যবসা হয় না, দূরের উপজেলাগুলোর সঙ্গে মানুষজনের যোগাযোগের বড় মাধ্যম নৌযান। শহরটি এখন প্রায় পর্যটকশূন্য। ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সড়কপথে কাঠ বহন প্রায় বন্ধ। অথচ এটাই এখানকার সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। সড়কপথের প্রভাব পড়েছে নৌপথে। দূরদূরান্তের বাগান থেকে নৌযানে করে কাঠ আনাও বন্ধ। ১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড়ধসের পর থেকে পার্বত্য এ এলাকার এমন দুরবস্থা।

নৌ ব্যবসায় ধস স্থানীয় অর্থনীতির একটি চিত্র মাত্র। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্রাক-বাস, খুচরা ও পাইকারি বাজার, ব্যাংকের লেনদেন—প্রায় সবখানেই এমনটা দৃশ্যমান। রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এক ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছে এ জেলার অর্থনীতি!’

ব্যবসায়ী সমিতির এই হিসাব যে বেশি বৈ কম হবে না, তা স্পষ্ট রাঙামাটির কাঠের আসবাব ব্যবসার চিত্রে।

আসবাবপত্র কল্যাণ সমিতির দেওয়া তথ্যমতে, পুরো জেলায় কাঠের আসবাবের দোকান আছে রয়েছে প্রায় ৬০০টি। শুধু রাঙামাটি শহরেই এ সংখ্যা ৩৫০টি। সমিতির উপদেষ্টা আবদুল ওয়াদুদ বললেন, প্রতিদিন রাঙামাটি থেকে ৫০ লাখ টাকার সামগ্রী বাইরে যায়। এখন তা প্রায় বন্ধ।

দিন-চুক্তিতে থাকা এ খাতের শ্রমিকদের একটি অংশ এর মধ্যে চাকরি খুইয়েছেন বলে জানান ওয়াদুদ।

শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে ট্রাকের সংখ্যা প্রায় ২০০টি। ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি জহির আহমেদ সওদাগর বলেন, ব্যবসা যখন ভালো যায়, তখন প্রতিদিন ২৫-৩০টি ট্রাক শুধু কাঠের পণ্যই বহন করে। ঢাকায় পণ্য পৌঁছাতে ট্রাকের ভাড়া ২৪ হাজার টাকার মতো। এখন এটি একেবারেই অচল।

১৩ জুনের পাহাড়ধসের পর এ শহরে বড় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এখনো তা স্বাভাবিক হয়নি। শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ঘাগড়া পর্যন্ত এখন বাস আসে। এ পথটুকুতে চলে শুধু অটোরিকশা ও পিকআপ।

গতকাল বুধবার সকালে শহরের নামী হোটেল সুফিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রাত যাপনের অতিথি তেমন নেই। এ হোটেলের ৬২টি কক্ষে ১২০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। হোটেল ব্যবস্থাপক সোহেল হাওলাদার বলেন, ‘আজ এই মুহূর্তে একজন আছেন। আর দুজন বুকিং দিয়ে রেখেছেন।’

ঈদের সময় ব্যবসা না হওয়ায় হোটেলগুলো সবচেয়ে বড় ক্ষতিতে পড়েছে। সুফিয়ায় আগাম অর্থ নিয়ে বিভিন্ন কক্ষ বুকিং রাখা হয়েছিল। বেশির ভাগ কক্ষের টাকা ফেরত দিতে হয়েছে বলে জানান সোহেল। কুলাতে না পেরে পাঁচ কর্মচারীকে বিদায় করতে হয়েছে।

পাহাড়, বনানী আর লেক শোভিত এ শহরে প্রায় সারা বছরই পর্যটক আসেন। শহরে মানসম্পন্ন হোটেলের সংখ্যা ৪০টি। সেখানে প্রায় তিন হাজার অতিথি থাকতে পারেন। শহরের ড্রিমওয়ে হোটেলে মালিক ও হোটেল ব্যবসায়ী সমিতির আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য মো. নিজামউদ্দিন বলেন, গড়ে হোটেল রেস্তোরাঁর ব্যবসায় এ শহরে ২৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়।

রাঙামাটির কোমরতাঁতের পোশাকের খ্যাতি রয়েছে। এখানে আসা পর্যটকদের বড় আকর্ষণও এসব পোশাক, স্থানীয় মানুষের হস্তশিল্প। শহরের তবলছড়ি বাজারে এসব সামগ্রীর অন্তত ১৮টি দোকান। আজ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে এ জায়গাটা খাঁ খাঁ করছিল। দোকানগুলো খুলে বসে আছেন বিক্রয়কর্মীরা। দোকানগুলো হরেক পণ্যে ঠাসা, অথচ ক্রেতা নেই। বয়ন নামের একটি দোকানের কর্মী পলি দেববর্মা বলেন, ‘আজ এখনো বউনি (প্রথম বিক্রি) হয় নাই। এমন দিন যায়, সারা দিনও একটি পোশাক বিক্রি হয় না।’

ঈদের পর আসা পর্যটকদের ওপর ভরসা করে পোশাকে ভরিয়ে তোলেন দোকানের মালিকেরা। রাঙামাটির স্থানীয় পোশাকশিল্পের পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান বেইন টেক্সটাইলের অন্যতম মালিক কৌশিক চাকমা বলেন, ‘আমার ৭৫ শতাংশ পণ্যই বিক্রি হয়নি।’
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অবস্থাও শোচনীয়। বনরূপা বাজারে ডিমের ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ প্রতিদিন ৩৫০-৪০০টি ডিম বিক্রি করতেন। তাঁর দোকানের ডিমের মূল ক্রেতা রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা। এখন এ সংখ্যা বড়জোর ১০০ বলে জানান ফারুক।

মৌসুমি ফল আনারস ও কাঁঠাল ব্যবসায় বড় ধরনের ধস হয়েছে পাহাড়ধসের পর। রিজার্ভ বাজারে আজ ছয়টি কাঁঠাল নিয়ে বসে ছিলেন ইব্রাহিম মিয়া। বলেন, পাহাড়ধসের পর তিনি এক কাঁঠাল পাঁচ টাকায় বিক্রি করেছেন। এখন ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারছেন। তবে দিন ভালো থাকলে এ কাঁঠাল ৬০ টাকার নিচে বিক্রি করতেনই না।

ব্যবসায়-বাণিজ্যের এই মন্দার প্রভাব ব্যাংকের লেনদেনেও পড়েছে। শহরের উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইমরান বললেন, ‘পাহাড়ধসের আগে এ ব্যাংকে গড়ে দৈনিক লেনদেন হতো প্রায় এক কোটি টাকা। এটা এখন অর্ধেকে গিয়ে ঠেকেছে।’ তিনি জানান, এখানে বড় লেনদেন হয় কাঠ ব্যবসার। এখন তার কিছুই নেই।

রাঙামাটির অর্থনীতির এই হালহকিকত মুঠোফোনে জানাই অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানকে। তিনি এ পরিস্থিতিকে ‘দুর্যোগের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রভাব’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারি ও নাগরিক আলোচনায় বিস্ময়করভাবে এ নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। স্থানীয় অর্থনীতির এটা একটা বিপর্যয়। কিন্তু সব আলোচনা এখন ধস, এর টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে হচ্ছে।’

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘গতানুগতিক সহায়তার বাইরে এসে ব্যবসার এসব বিষয় সরকারকে আমলে নিতে হবে। মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এটা জরুরি।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একমাত্র অঞ্চল, সুনির্দিষ্টভাবে যার উন্নয়নে একটি মন্ত্রণালয় আছে। ভয়াবহ দুর্যোগ-পরবর্তী এ অঞ্চলের অর্থনীতি যে সরকারি ভাবনায় নেই, তা স্পষ্ট হলো পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুরের কথায়। তিনি বলেন, ‘সত্যিই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমরা ত্রাণের বিষয়টি নিয়ে বেশি তৎপর বলে এ নিয়ে ভাবতে পারিনি।’

রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স চায় এ ব্যাপারে সরকারিভাবে একটি পরিকল্পনা করা হোক। নাজুক অর্থনীতি উদ্ধারে এ প্রতিষ্ঠান কিছু প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে করবে। এর মধ্যে আছে অন্তত দুই মাস ঋণের সুদ মওকুফ, ঋণের পুনঃ তফসিল করা।
পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বললেন, ‘এসব প্রস্তাব আমাদের কাছে দেওয়া হোক। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা সুপারিশ করব।’ সূত্র: প্রথম আলো