পাখির কাছে ফুলের কাছে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে

দুয়োর বেঁধে রাখ।/ কেন বাঁধবো দোর জানালা

তুলবো কেন খিল?/ আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে

ফিরবে সে মিছিল।/ ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!

ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/ মতিয়ুরকে ডাক।

কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে।

তোরাই তবে সোনামানিক/ আগুন জ্বেলে দে।

ঊনসত্তরের ছড়া

আল মাহমুদ খুব বেশি ছড়া লেখনি, কিন্তু এক সময় সেই পাকিস্তানি আমলের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে তার সস্তা কলম দিয়েই তিনি এমন ছড়াই লিখেছিলেন। আমার সৌভাগ্য তার সোনালী কাবিনের অধিকাংশ কবিতাই আমি পাণ্ডুলিপি অবস্থায় পড়েছিলাম- পুরনো একটি ডায়েরিতে তিনি লিখতেন, তার পড়ার সময় আত্মপ্রেমে মশগুল নিজের সাফল্যে ডগমগ কবি কী উচ্ছ্বাস নিয়ে পড়তেন, আমার স্মৃতিতে তা উজ্জ্বল হয়ে গেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাজীপাড়ার সেই বাসায় তার নিত্যসঙ্গী মোহাম্মদ মুদাই অধিকাংশ সময় লুঙ্গি পরিহিত, একবার স্রেফ লুঙ্গি আর গেঞ্জি গায়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন মনে পড়ে গেল, তাই এখনই লিখে ফেলি, এই বাসায় আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, সে সময়ের রাজনীতি নিয়ে যে আলাপচারিতা করছিলেন তাও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

সে সময় তিনি চট্টগ্রামের বই ঘর-এ কাজ করছেন, থাকতেন ইকবাল রোডের এক চিলেকোঠায়। তার কক্ষসঙ্গী ছিলেন আমার অসম্ভব প্রিয় শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। বিদ্যুৎসংযোগ ছিল না। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব হ্যারিকেনের চিমনি মুছতে মুছতে গাইছেন- কিরিচ তেল, কিরিচ তেল…। আমার খালাতো বোন শাম্মী, বোধ হয় সিক্স-সেভেনে পড়ে- সে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

সোনালী কাবিনের অনেক পঙ্ক্তির মধ্যে যে শাশ্বত বাংলা বর্ণিল হয়ে আছে- খুঁজলে দেখা যাবে শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবকেও পাওয়া যাবে হয়তো। আহা, আজ দু’জনই আর নেই।

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ দুপুর বেলার অক্ত

বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/ বরকতের রক্ত।

হাজার যুগের সূর্যতাপে/ জ্বলবে এমন লাল যে,

সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/ কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে।

প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে/ ছড়াও ফুলের বন্যা

বিষাদগীতি গাইছে পথে/ তিতুমীরের কন্যা।

চিনতে না কি সোনার ছেলে/ ক্ষুদিরামকে চিনতে?

রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে/ মুক্ত বাতাস কিনতে?

পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়/ ঝাঁপ দিল যে অগ্নি.

ফেব্রুয়ারির শোকের বসন/ পরলো তারই ভগ্নী।

প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে,

বাংলা আমার বচন, আমি/ জন্মেছি এই বঙ্গে

একুশের কবিতা

নাম একুশের কবিতা, সে তো গত শতাব্দীর ’৫২-র অর্জন- অথচ তিনি কত অনায়াসে বরকতের সঙ্গে, চট্টগ্রামের সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের যুক্ত করেছেন, তিতুমীরের কন্যাও সঙ্গী হয়েছেন এই কবি। একুশের কবিতার, নাকি ছড়ার, নাকি পদ্যের শেষ দুই পঙ্ক্তিতে কী অসাধারণ স্বীকারোক্তি বাংলা আমার বচন, আমি/জন্মেছি এই বঙ্গে।

সোনালি কাবিনের কথাটি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, হঠাৎ করেই একটি পত্রিকায় বিবিসির উদ্ধৃতি দেখে মনে পড়ল। তাইতো- আমি তো আর শুনিনি, হয়তো আপনিও মিস করেছেন, পত্রিকার ক্লিপিং থেকে অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি।

‘প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। কিন্তু সোনালি কাবিন আল মাহমুদকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। আল মাহমুদের কবিতা বাংলাদেশের অনেক কবিকে প্রভাবিত করেছিল। এদের মধ্যে কবি আসাদ চৌধুরী অন্যতম। আল মাহমুদের কবিতা শুধু তাকেই নয়, বহু পাঠককে প্রভাবিত করেছে।

বিবিসিকে আসাদ চৌধুরী বলেন, আমি অজস্র মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি, সোনালী কাবিন তাদের মুখস্থ। আর মাহমুদের কবিতার বিষয় হিসেবে প্রথম দিকে গ্রামের জীবন, বামপন্থী চিন্তাধারা ও নারী মুখ্য হয়ে উঠলেও পরে ইসলামী ভাবধারাও প্রবল হয়ে ওঠে।

মাহমুদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান-ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে বলে উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ।

আল মাহমুদ কবি হলেও তিনি নিজেকে রাজনৈতিক দর্শন থেকে দূরে রাখেননি। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, কবি আসাদ চৌধুরী আল মাহমুদকে বিচার করেন তার লেখা ও শিল্পের বিচারে। শুরুর দিকে বামপন্থী চিন্তাধারার হলেও, সেখান থেকে সরে এসে আল মাহমুদ কেন ইসলামী ভাবধারার দিকে ঝুঁকলেন? ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।

আল মাহমুদ সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি কখনও মার্কসবাদী ছিলেন না বরং তার চরিত্রে এক ধরনের দোদুল্যমানতা ছিল। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমি যে পরিবারে জন্মেছি তারা সবাই ছিলেন খুব ধর্মপ্রবল লোক। কিভাবে যেন তাদের মধ্যেই যে রয়েছে সত্যিকারের পথের ঠিকানা এটা আমাকে দূর থেকে ইশারায় ডাকত।

আসাদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো তারও ক্ষোভ বেশি ছিল এবং ক্ষোভের প্রকাশটা রাজনৈতিক আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। যেটা অনেকে পছন্দ করেননি। কিন্তু শিল্পীকে বিচার করতে হয় শিল্পের মাপকাঠিতে। আল মাহমুদকে বিচার করতে হবে তার কবিতা দিয়ে।’

কবে কী বলেছিলাম, আমার সত্যি মনে নেই। থাক, না, আমার মত পাল্টানোর মতো কিছু আর ঘটেনি।

তিনি কেন ঊনশত্তরে এক ছড়া লিখলেন, তবে কি তার লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর মতো দেশের তরুণ সমাজ। পাকিস্তান হওয়ার পরপরই তিনি ছাত্রদের সংগঠিত করার জন্য গোটা বাংলাদেশ চষে বেরিয়েছিলেন। নদী খননের কাজ করার সুবাদে আল মাহমুদও তো বাংলাদেশ ঘুরেছিলেন। দিনটার কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল।

নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল

ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল।

ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে এলেম ঘর

ঘুমন্ত এই মস্ত শহর করছিলো থরথর।

মিনারটাকে দেখছি যেন দাঁড়িয়ে আছেন কেউ,

পাথরঘাটার গির্জেটা কি লাল পাথরের ঢেউ?

চৌকিদারের হাঁক শুনে যেই মোড় ফিরেছি বায়-

কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিল আয় আয়।

পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লাল দীঘিটার পাড়

এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার।

আমায় দেখে কলকলিয়ে দীঘির কালো জল

বললো, এসো, আমরা সবাই না ঘুমানোর দল-

পকেট থেকে খুলো তোমার পদ্য লেখার ভাঁজ

রক্তজবার ঝোপের কাছে কাব্য হবে আজ।

দীঘির কথায় উঠলো হেসে ফুল পাখিদের সব

কাব্য হবে, কাব্য হবে- জুড়লো কলরব।

কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই

পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই।

আল মাহমুদ, মানুষের কাছে নয় কেন? যে বাঙালি নিয়ে আপনার এত অহঙ্কার তাদের কাছে নয়। বাংলার মানুষ আর প্রকৃতিকে তিনি অভিন্ন করে ফেলেছেন- তাই অনায়াসে বলতে পারলেন, ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে, মনের কথা কই।’

আমি জানি না, কিংবদন্তির খনাকে নিয়ে তার আগে বা পরে কেউ এরকম কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন কী না। তিনি নজরুলের মতোই কত অনায়াসে হিন্দু-মুসলিম থিম নিয়ে লিখে গেছেন, একমাত্র নির্মলেন্দু গুণ ছাড়া আর কারও লেখায় সেভাবে পাইনি। খনাকে নিয়ে ৫টি সনেট তিনি লিখেছেন প্রথম সনেটটিকেই তিনি সতর্কবাণীও শুনিয়েছেন।

ঋতুর রহস্য গাই, এ দোষে কি কেটে নেবে জিব?

তাহলে হে পুরুষেরা কাটো শত কবির রসনা,

নিয়মের মন্ত্র লিখি। লাক্ষণিক নক্ষত্রের দীপ

নারীর প্রেরণা হয়, তোমরা শোনো খনার বর্ণনা।

যে মাঘে বুকের মাংস গুটি বেঁধে হয়েছে স্তনন

তখন থেকেই জেনো নারী শেখে নিসর্গের ভাষা

আগাম ইশারা হয়ে ঝরে যায় খনার বচন

চাষার ঘামে ও কামে তড়পায় শস্যের পিপাসা।

নাক কান কেটে যদি কবিত্বকে খনা করে কেউ

প্রকৃতির প্রতিশোধ বজ হয়ে নামে শালিধানে;

অভাবের বাঘ আসে, ফেউ হাসে, বিড়ালীর মেউ

রাজার ভাঁড়ারে বসে প্রজাদের দুর্ভাগ্য বাখানে।

যে দেশে কবির ঠোঁটে ছুঁচ দ্যায় রাজার সেপাই

সে মাটিতে মেঘবৃষ্টি প্রকৃতির ষড়ঋতু নাই।

আল মাহমুদের অপ্রকাশিত কবিতা

গান ধরেছে পুষ্প-পাখি

কবি আসাদ চৌধুরী; প্রিয় বন্ধু-প্রিয় অনুজ

কি আর লিখি- কি আর দেবো কবিতার আহ্বান

আকাশ থেকে ডাকছে আমায় মেঘের কলতান

গান ধরেছে পুষ্প পাখি দুলছে লতাপাতা

হঠাৎ মনে হলো আমার, কাব্য-গানের খাতা।

সেই খাতাতে বাঁধ মানেনা অনেক কবির নাম

নামের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই প্রীতি ও সালাম

দাম দেবে কে ছন্দ গাঁথার, দাম দেবে কে কার?

কাব্য হলো নাব্য কোন নদীরই উদ্দাম-

কেউ চলেছে ডাইনে একা- কেউ ধরেছে বাম

ঢেউয়ের দোলা ছন্দে খোলা গন্ধ মাতাল মন,

আসাদ হলো আমার সকল প্রিয়দের একজন।