দুর্ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

পশ্চিমাঞ্চল রেলে গেটম্যান নেই অর্ধেক লেভেল ক্রসিংয়ে

আমজাদ হোসেন শিমুল:

রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগ নিয়ে গঠিত পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ১৫৬৮ কিলোমিটার রেলপথে ১ হাজার ৪৩৯টি রেল ক্রসিং গেইটের প্রায় অর্ধেকই যেন মৃত্যুপুরী। রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে অনুমতির বৈধতা-অবৈধতার মারপ্যাচেই যেন বন্দি এসব লেভেল ক্রসিং। প্রায় দেড় হাজার লেভেল ক্রসিংয়ে কাগজে-কলমে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৮৯ জন গেটকিপারের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ৭০০ জন গেটকিপার দায়িত্বে রয়েছে। হিসাব অনুযায়ী- পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রায় অর্ধেক লেভেল ক্রসিং গেইট অরক্ষিত থাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ের পাকশী ও লালমনিরহাট বিভাগ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগের আওতাধীন অনুমোদিত বা বৈধ লেভেল ক্রসিং (ট্রাফিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং) গেইট রয়েছে ৮০৮টি এবং অননুমোদিত বা অবৈধ গেইট রয়েছে ১২৩টি। আর লালমনিরহাট বিভাগে অনুমোদিত বা বৈধ লেভেল ক্রসিং গেইট (ট্রাফিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং) রয়েছে ৪১৭টি এবং অননুমোদিত বা অবৈধ গেইট রয়েছে ৯৯টি। সেই হিসেবে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আওতায় ১ হাজার ৪৩৯ টি লেভেল ক্রসিং গেইটের ২২২টিই অননুমোদিত বা অবৈধ। আর এসব অননুমোদিত গেইটের মধ্যে এলজিইডির রয়েছে ১৮৪টি। এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সওজের রয়েছে ৫টি। বাকিগুলো ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের অধীনে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- ১ হাজার ৪৩৯টি লেভেল ক্রসিং গেইটের জন্য মঞ্জুরিকৃত গেটকিপার ছিল ১৮৯ জন। এদের মধ্যে ১১৯ জন গেটকিপার স্বপদে কর্মরত। বাকি ৭০ জনকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, মঞ্জুরিকৃত ১৮৯ জন ছাড়াও প্রায় ৭০০ জন গেটকিপার প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করছেন। হিসাব অনুযায়ী, ৬২০টি লেভেল ক্রসিং গেইটে কোনো গেটকিপার না থাকায় গেইটগুলো পুরোপুরি অরক্ষিত।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে বৈধ ও অবৈধ এসব লেভেল ক্রসিং গেইটের মধ্যে ৮১৯টিতে গেটম্যান থাকার কথা বলা হলেও এসব গেটম্যানের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। মঞ্জুরিকৃত ১১৯ জন গেটকিপার কোনোরকম তাদের দায়িত্ব কিছুটা পালন করলেও প্রকল্পের মাধ্যমে গেটকিপারের দায়িত্বে থাকা ৭০০ গেটকিপারের অধিকাংশই তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেন না। আবার যে লেভেল ক্রসিং গেটগুলোতে গেটম্যান নেই সেগুলোর সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ২২২টি ক্রসিংয়ের অধিকাংশের সামনেই নেই সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড। ফলে অনেক সসময় পথচারিরা লেভেল ক্রসিং অতিক্রমের সময় অসাবধানতাবশতঃ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- গত সোমবার (২৪ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৮টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে অরক্ষিত একটি রেলক্রসিংয়ে ভুটভুটি অতিক্রম করার সময় ট্রেনের ধাক্কায় তিনজন মাছ ব্যবসায়ী নিহত হয়। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর নীলফামারী সদরের বউবাজার রেলস্টেশন এলাকায় ট্রেনের নিচে কাটাপড়ে একই পরিবারের তিন শিশু চারজন নিহত হয়েছেন। গত ৫ জানুয়ারি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ট্রেন ও ট্রাকের সংঘর্ষে ট্রেন চালক আব্দুর রশিদ সরকার ও সহকারী চালক ইউনুস আলী গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তাঁদের দুজনকে চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। গত ৬ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় নাটোর শহরের তেবাড়িয়া রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের সঙ্গে ও ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুড়িগ্রামগামী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়। অথচ ওই লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান ছিল না। গত ২ ডিসেম্বর পাবনার ভাঙ্গুরা ও পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনে দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত এক ডিসেম্বর নাটোরের লালপুরের আজিমপুর রেলওয়ে স্টেশনে রেললাইন পারাপারের সময় ঢাকাগামী দ্রুতযান এক্সপ্রেসের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে ছেলেকে বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি করাতে এসে খুলনা সদরের হেমায়েত উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি মারা যান। এর আগে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় এমনই একটি অরক্ষিত ক্রসিংয়ে ২০১৯ সালের ২০ জুলাই দুর্ঘটনায় বর-কনেসহ ১২ জন প্রাণ হারান। এভাবেই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেইটের কারণে দুর্ঘটনায় শত শত প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে। রেলওয়ের হিসাবমতে- ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ১৯৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওসব দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে রেলগেটে সংঘটিত দুর্ঘটনায় ১৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ তাদের প্রায় সবাই লেভেল ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী।

বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মাইর-প্যাচসহ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এভাবেই প্রতিনিয়ত ঘটছে রেল দুর্ঘটনা। রেল সংশ্লিষ্ট অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, রেলপরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতা এবং অন্যান্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরই সৃষ্ট পশ্চিম রেলের এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেইট। আর এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণেই ট্রেন চলাচলে প্রতিনিয়ত বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে আইন ১৮৯০ এর ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তি ট্রেনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে বা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাঁর সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে- প্রতিনিয়ত সরকারের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি কিংবা জনপ্রতিনিধি অবৈধভাবে লেভেল ক্রসিং গেইট তৈরী করছে। যার কারণেই প্রতিনিয়ত অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেইট বাড়ছে, ঘটছে দুর্ঘটনাও।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে- প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রয়োজনের ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি কিংবা অন্যরা লেভেল ক্রসিং গেইট সৃষ্টি করছে, যা অবৈধ। প্রতিনিয়ত এভাবে অবৈধ গেইট সৃষ্টি হলে রাতারাতি সেখানে জনবল দেয়া রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সম্ভব না। অবৈধ লেভেল ক্রসিং যাতে তৈরী না হয় সেজন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে স্থায়ী কিছু গেটকিপার রয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৭০০ গেটকিপার অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মে নিয়োজিত রয়েছে।’

তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে লেভেল ক্রসিং গেটগুলোতে ঠিকমত গেটকিপার রাখা সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণেই এভাবে ট্রেন দুর্ঘটনা লাঘব করা যাবে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিজ্ঞানসম্মতভাবে দেশের লেভেল ক্রসিংগুলো করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, লেভেল ক্রসিং হবে রাস্তার সমান্তরাল। কিন্তু দেশের অধিকাংশ লেভেল ক্রসিং হয় উচু, নয়তো নিচু। যার কারণে লেভেল ক্রসিং অতিক্রম করার সময় যানবাহন ক্রসিং আটকে যায় নয়তো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রতিনিয়ত ক্রসিংয়ে ঝড়ে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। তবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ‘ওভারপাস’ এবং ‘আন্ডারপাস’ তৈরী করা সম্ভব হলে দেশে লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর মিছিল কিছুটা হলেও কমবে।’

এএইচ/এস