পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে: অপ্রয়োজনে কেনা কোটি টাকার মালামালেরও মিলছে না হদিশ

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মালপত্র কেনাকাটার নিরীক্ষা করতে গিয়ে অভিনব সব দুর্নীতির দেখা পায় পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা (অডিট) কমিটি। আগুনদামে কেনার পর অনেক ক্ষেত্রে মালপত্র হাওয়া হয়ে যাওয়ার সত্যতাও মিলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইচ্ছা করে বেশি দামে চুক্তি করে মালপত্র কেনার নজির রয়েছে। বিনা প্রয়োজনে নিয়োগ করা হয়েছিল পরামর্শক।

বিধিবহির্ভূতভাবে কেনা হয়েছে অনেক মালপত্র। শুধু তা-ই নয়, একাধিক ক্ষেত্রে মালপত্র সরবরাহ ছাড়াই বিল পরিশোধের আয়োজনও করেছিলেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এতে রেলওয়ের ক্ষতি হয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করতে পারেনি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। তাদের আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা কম হয়েছে। এ রকমই তথ্য উঠে এসেছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলওয়ের মালপত্র কেনাকাটা ও অন্য বিষয় নিয়ে পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেলওয়ে মালপত্র কিনলেও তার অনেক কিছুই নিরীক্ষার সময় পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অধীন নাটোর স্টেশনে ২৫টি পর্দা মজুদে কম দেখা গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে তিন লাখ ৬৪ হাজার ৭৫০ টাকার। ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর পাকশী রেলওয়ের অধীন নাটোর স্টেশনের জন্য ৫০টি উন্নত মানের ভিআইপি পর্দা কেনা হয়। প্রতিটি পর্দার দাম ১৪ হাজার ৫৯১ টাকা হিসাবে দাম পরিশোধ করা হয়, কিন্তু ৫০টির বদলে সরবরাহ করা হয় ২৫টি পর্দা। 

একই অর্থবছরে খুলনা রি-মডেলিং স্টেশনের জন্য কেনা পর্দার মধ্যে ৯৪টি মজুদে কম পাওয়া যায়। এতে রেলওয়ের ক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ ৫৪ হাজার ৮২১ টাকার। খুলনা রি-মডেলিং স্টেশনের বিভিন্ন কক্ষে ব্যবহারের জন্য ২৪৬টি উন্নত মানের ভিআইপি পর্দা কেনা হয়েছিল। ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর স্টেশন মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকার পর্দাগুলো বুঝে নেন এবং মজুদ রেজিস্টারে এন্ট্রি করেন। নিরীক্ষা কর্মকর্তারা এ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে খুলনা রি-মডেলিং স্টেশনে গিয়ে যাচাই করে ১৫২টি পর্দা পান। বাকি ৯৪টি পর্দা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

খুলনা রি-মডেলিং স্টেশনে সাত লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ টাকা দরের ১৬টি স্টিল আলমারি অরিজিন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহ না করায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। খুলনা রি-মডেলিং স্টেশনের জন্য  ‘অটবি’ বা ‘হাতিল’ ব্র্যান্ডের ১৬টি স্টিল আলমারি কেনার কথা, যার প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার ৯১২ টাকা। অথচ স্থানীয় বাজার থেকে নন-ব্র্যান্ডের ১৬টি স্টিল আলমারি কেনা হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সাত লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ টাকার।

এ ব্যাপারে ওই সময় খুলনা রি-মডেলিং স্টেশন কর্তৃপক্ষ নিরীক্ষা কর্মকর্তাদের জানায়, মালপত্র সরবরাহ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রাজশাহী কার্যালয় থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ওই চুক্তির অনুলিপি মালপত্র সরবরাহের সময় সরবরাহ করা হয়নি। এ জন্য মালপত্র বুঝে নেওয়াও সম্ভব হয়নি। 

ঈশ্বরদী থেকে ঢালার চর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিনা প্রয়োজনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসিই কনসালট্যান্ট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে ১৫ কোটি ১৬ লাখ ৩২ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে উল্লিখিত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা পুরোটাই অপ্রয়োজনীয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেলওয়ের নিজস্ব সুদক্ষ প্রকৌশলী রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কোড এবং ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্কস ম্যানুয়াল। সুদক্ষ লোকবল এবং সুনির্দিষ্ট ও সঠিক নির্দেশনা থাকার পরও পরামর্শক নিয়োগ অপ্রয়োজনীয় বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানও তাদের কাজ যথাযথভাবে করেনি। কনসালটেন্সি ফি হিসেবে দেওয়া পুরো ১৫ কোটি ১৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কোড অনুযায়ী কাজ শেষ হলে পরিমাপ গ্রহণের প্রয়োজন হবে এবং পরিমাপের ভিত্তিতে বিল পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঈশ্বরদী থেকে ঢালার চর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে এই নিয়ম মানা হয়নি। নিয়ম না মেনেই ৩১৩ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে, যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজে রেল কর্তৃপক্ষের কোনো তদারকি ছিল না। ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে নিয়ম না মেনেই।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১১টি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে কেনা মালপত্র সরবরাহ না করে দুই কোটি ৫৬ লাখ ২৪ হাজার ১৪৮ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ২২০টি লাগেজ ট্রলি কেনার জন্য গত বছরের ১৭ জুন ২২০টি ‘প্রেসিডেন্ট’ ব্র্যান্ডের লাগেজ ট্রলি (ইন্ডিয়া) সরবরাহ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে অডিট চলার সময় ওই ট্রলির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

৫০টি উন্নত মানের শাবল ও ১০০টি দুরমুজ কেনার ক্ষেত্রেও অনিয়ম করা হয়েছে। প্রতিটি শাবল পাঁচ ফুট লম্বা এবং ওজনে ১২ কেজি হওয়ার শর্ত থাকলেও বাস্তবে যে শাবল কেনা হয়েছে তার প্রতিটির দৈর্ঘ্য তিন ফুট ৯ ইঞ্চি এবং ওজন চার কেজি ৫০০ গ্রাম। একইভাবে পাঁচ কেজি ওজনের দুরমুজের বদলে তিন কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের দুরমুজ সরবরাহ করা হয়েছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার বাজারদর যাচাই কমিটি গঠন না করেই অনিয়মের মাধ্যমে ২৫ লাখ ২১ হাজার ৯০৫ টাকার মালপত্র কিনেছেন, যা বিধিসম্মত নয় বলে নিরীক্ষায় আপত্তি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে বিভাগীয় ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট লালমনিরহাট কার্যালয় রেলওয়ের যথাযথ বিধি না মেনে এক কোটি ৫৬ লাখ ৯৭ হাজার ১২৮ টাকার মাল কিনেছেন।

এদিকে টিকিটপ্রতি কমিশন চুক্তি না করে যাত্রীপ্রতি কমিশন চুক্তি করে রেলওয়ের এক কোটি ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১১২ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের (পশ্চিম) চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ ভুঁঞা বলেন, ‘বিভিন্ন স্টেশনের মজুদে মালপত্র কম থাকা এবং অন্য যেসব অভিযোগ উঠছে, সেসব বিষয়ে আমার জানা নেই। পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের কোনো নিরীক্ষা প্রতিবেদন আমার হাতে এখনো আসেনি। হয়তো আসবে। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর আমি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ