পরীক্ষা না হওয়ায় মৃত্যুর তালিকার বাইরে অনেকে!

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। এর ঠিক ১০দিন পর (১৮ মার্চ) প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী মারা যান দেশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বিদেশফেরত স্বজনের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার ১৩৩ দিনের মাথায়, ১৭ জুলাই সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে ১৮ জুলাই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে, চিকিৎসার অভাবে, শনাক্তের বাইরে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। লক্ষণ-উপসর্গ নিয়েও অনেকে মারা গেছেন যেগুলো পরে পরীক্ষার বাইরে থেকে গেছে। সেসব সন্দেহজনক মৃত্যু অর্ন্তভুক্ত হচ্ছে না অধিদফতরের তালিকায়। ফলে করোনায় মৃত্যুর আসল সংখ্যা অনুমান করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

করোনা ট্র্যাকার ডট কমের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এশিয়ায় এক লাখের বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কেবল সৌদি আরবে মৃত্যু হার কম। এশিয়ার মধ্যে ইরানে ৫ দশমিক ১ শতাংশ, ভারতে এই হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ, পাকিস্তানে ২ দশমিক ১ শতাংশ এবং সৌদি আরবে ১ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মৃত্যুর হার কম এটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। কিন্তু হাসপাতালের বাইরে ও পরীক্ষা না হওয়ায় অনেকেই অর্ন্তভুক্ত হচ্ছেন না অধিদফতরের তালিকায়, রয়ে যাচ্ছেন হিসাবের বাইরে।

সময়ের হিসাব

১৮ মার্চে প্রথম রোগীর মৃত্যু হলেও সে মাসে মারা যান পাঁচ জন। এপ্রিল মাসে মারা যান ১৬৩ জন, মে মাসে মারা যান ৪৮২ জন, জুন মাসে এক হাজার ১৯৭ জন আর চলতি মাসে ১৮ জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন ৭৩৪ জন।

৬ এপ্রিল থেকে নিয়মিত মৃত্যুর সংবাদ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ৬ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০ জনের মধ্যে, ১০ থেকে ১৭ মে পর্যন্ত মৃত্যু হয় ১১ থেকে ১৯ জনের মধ্যে। ১৮ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দুদিন বাদে মৃত্যু হয় ২০ থেকে ২৮ জনের। গত ৩১ মে থেকে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা ৩০-এর ওপর চলে যায়।

গত ২৫ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের মোট সংখ্যা ৫০১ জনে দাঁড়ায়। ১০ জুন মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়ায়। সেদিন ৩৭ জনের মৃত্যুসহ মোট এক হাজার ১২ জনের মৃত্যু সংবাদ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

প্রথম রোগী মারা যাওয়ার এক মাস দুইদিন পর ২০ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়ায়, ২৫ মে ছাড়ায় ৫০০ জন। গত ১০ জুন মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়, ২২ জুন ছাড়ায় দেড় হাজার, ৫ জুন ছাড়ায় দুই হাজার আর আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেল ১৭ জুলাই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্যে মৃত্যু সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গত ১৮ মার্চে প্রথম মৃত্যুর পর ৫০০ জন ছাড়াতে সময় লেগেছে দুই মাস সাত দিন, ৫০০ থেকে এক হাজার জনের মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১৬ দিনে, এক হাজার থেকে মৃত্যু দেড় হাজার জনে পৌঁছায় ১২ দিনে, দুই হাজার জন হয়েছে ১৩ দিনে, আর আড়াই হাজার ছাড়িয়েছে ১২ দিনে।

সবচেয়ে বেশি ষাটোর্ধ্ব এবং ঢাকা বিভাগে

এ পর্যন্ত যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে ১৭ জন, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ২৯ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৭৭ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ১৭৯ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৩৬৬ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৭৫৭ এবং ষাটোর্ধ্ব এক হাজার ১২২ জন রয়েছেন।

এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে রয়েছেন এক হাজার ২৫৫ জন, যা ৪৯ দশমিক ২৮ শতাংশ; চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৫৫ জন, যা ২৫ দশমিক ৭২ শতাংশ; রাজশাহী বিভাগে ১৩১ জন, যা ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ; খুলনা বিভাগে ১৫৫ জন, যা পাঁচ দশমিক ৮৯ শতাংশ; বরিশাল বিভাগে ৯৭ জন, যা তিন দশমিক ৮১ শতাংশ; সিলেট বিভাগে ১১৬ জন, যা চার দশমিক ৫৫ শতাংশ; রংপুর বিভাগে ৮৭ জন, যা তিন দশমিক ৪২ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৬ জন, যা দুই দশমিক ২০ শতাংশ।

নারী পুরুষের হার

এখন পর্যন্ত মোট নারী মারা গেছেন ৫৪১ জন; যা ২১ শতাংশের বেশি। আর পুরুষ দুই হাজার ৪০ জন যা প্রায় ৭৯ শতাংশ।

উপসর্গ নিয়ে মৃতরা তালিকায় নেই

বাড়িতে, হাসপাতালে যারা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন তাদের সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শুরু থেকে বলে আসছি সরকারি তালিকায় সব থাকতে হবে। যদি করোনা না হয় তাহলে সেটাও বলতে হবে। একইসঙ্গে যারা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন তাদেরও অ্যাড্রেস করতে হবে। গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা স্বাস্থ্য অধিদফতরের বুলেটিনে বলা হচ্ছে না, এটা বলা উচিত। যে কোনও মহামারিতে কতজন মারা গেলেন, উপসর্গ নিয়ে কতজন মারা গেলেন সেটা অবশ্যই সরকারিভাবে আসতে হবে। এতে নজরদারি করতে সুবিধা হবে, ব্যবস্থা নিতেও সুবিধা হবে।’

ল্যাবরেটরিতে কনফার্ম করা না হলেও করোনায় সন্দেহজনক মৃত্যু হলে সে পরিসংখ্যানও দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘যারা লক্ষণ নিয়ে মারা যাচ্ছেন সেগুলোও রেকর্ডে থাকা উচিত বলে মনে করি আমি।’

করোনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরেও অনেকে মারা গেছেন উল্লেখ করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘অনেক রোগী বাসায় মারা গেছেন। কোভিড আক্রান্ত হয়ে ঠিক কত মানুষ মারা গেছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান কিন্তু কোথাও নেই।’

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ডেটা কালেকশন হচ্ছে না ঠিকমতো। অনেকে লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন, অনেকে বাসায় মারা গেছেন, তাদের নমুনা নেওয়া হয়নি। তাই করোনায় মোট মৃত্যুর তালিকা বর্তমান অনুমিত হিসেবের চেয়ে বেশি হবে।’

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা জরুরি ছিল

করোনা আক্রান্ত যত রোগী রয়েছেন তাদের প্রত্যেককে প্রথমদিন থেকে ফলোআপ করা অত্যন্ত জরুরি বলে জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এটা স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব। গত এপ্রিল পর্যন্ত আইইডিসিআর সে কাজ করলেও মে মাস থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর সে দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। নমুনা সংগ্রহেই কেবল তারা সীমাবদ্ধ থেকেছে। প্যাশেন্ট ফলোআপ করে নাই। তাকে আইসোলেশন নিশ্চিত করা, তার কন্টাক্ট ট্রেসিং করে কোয়ারেন্টিন করা, এটা করতে পারলে রোগী খারাপ অবস্থায় যাওয়া মাত্র হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হতো। যেমনটা প্রথম দিকে আইইডিসিআর করেছিল। এটা করতে পারলে ঘরের মৃত্যুগুলো কমানো সম্ভব হতো। মনে রাখতে হবে, করোনা ভাইরাসের ম্যানেজমেন্ট অন্যান্য সময়ের ম্যানেজমেন্টের চেয়ে আলাদা।’

তিনি বলেন, ‘ইনফেকশন কন্ট্রোল, লাইফ সেভিং এর সিদ্ধান্ত নেওয়া, চিকিৎসকদের উজ্জীবিত রাখা, সহযোগিতা করা, প্রশিক্ষনৈ সিনিয়র চিকিৎসকদের অর্ন্তভুক্ত করা-এসব ম্যানেজমেন্টের সমস্যা। ম্যানেজমেন্ট ঠিক রাখা গেলে নিশ্চয়ই মৃত্যু কমানো যাবে। প্রথম দিন অর্থাৎ করোনা পজিটিভ হওয়ার দিন থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত-সব জায়গায় সেটি করতে হবে।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার কম এটা অবশ্যই একটা ভালো দিক। তবে যত মৃত্যু হয়েছে সেটাও আরেকটু কমানো যেত যদি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকতো। হাসপাতাল অব্যস্থাপনার কারণে অনেকে হাসপাতালেই আসেননি, ভর্তি হতে পারেননি। তাই হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা গেলে মৃত্যুহার কমিয়ে রাখা যেত।’

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন