এরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

এ মুহূর্তে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আলোচিত দুটি নাম মো. সাহেদ আর ডা. সাবরিনা। সেই সঙ্গে আছে আরিফ চৌধুরীর নামও। টিভি টকশোর পরিচিত মো. সাহেদের চেহারার সঙ্গে বর্তমান সাহেদকে যেন মেলানো যায় না- তার সেই কাঁচা-পাকা চুল, গোঁফ নিয়ে বুদ্ধিজীবী মার্কা যে চেহারা, সেই চেহারার সঙ্গে বর্তমান চেহারার কোনো মিল নেই। চুলে কলপ দিয়ে কিংবা গোঁফ ছেঁটে তিনি চেহারায় পরিবর্তন এনেছেন।

আর ডা. সাবরিনার যত ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরেফিরে আসছে, তাতে তাকে হৃদযন্ত্রের ডাক্তারের চেয়ে একজন আবেদনময়ী ‘নায়িকা’ হিসেবেই বেশি মানানসই লাগছে। তার এ চেহারা ও ছবির কারণে মিডিয়ায় হারিয়ে গেছে তার ‘স্বামী’ আরিফ চৌধুরীর ছবি। এরা তিনজনই এখন পুলিশের হেফাজতে। তিনজনকেই রিমান্ডে নিয়ে তথ্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করছে পুলিশ। আমরা জানি না পুলিশ তাদের কাছ থেকে কতটুকু তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারবে; কিন্তু আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এ ক্ষতিপূরণ আমরা কীভাবে করব? ইতালি সেদেশে আপাতত বাংলাদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশিদের নিয়ে রোম বিমানবন্দরে অবতরণকারী কাতার বিমানকে ফেরত পাঠিয়েছে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। অভিযোগটি মারাত্মক।

ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্তো স্পেরাঞ্জা বাংলাদেশ থেকে আসা সব ফ্লাইট স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছেন (Big business in Bangladesh: Selling fake coronavirus certificates, The New York Times, 16 July). বাংলাদেশিদের করোনাভাইরাস ‘পজিটিভ’। অথচ সবার কাছেই করোনাভাইরাস ‘নেগেটিভ’ সনদ ছিল। অর্থাৎ তাদের শরীরে করোনাভাইরাস নেই- এ ধরনের সনদ ছিল। বাস্তবে ওই সনদ ছিল ভুয়া। আর এই ভুয়া সনদ ইস্যু করার কারণেই সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালের দুটি শাখা (উত্তরা ও মিরপুর) বন্ধ করে দিয়েছে র‌্যাব। একই সঙ্গে জেকেজি নামে একটি কোম্পানি করোনাভাইরাসের জন্য স্যাম্পল সংগ্রহ করে সনদ দিত। তারা ইতোমধ্যে ১৫ হাজার ৪৬০টি সনদ দিয়েছে। অথচ এখন জানা যাচ্ছে, তারা কোনো ধরনের টেস্ট না করেই ভুয়া সনদ দিত। সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে তারা সনদপ্রতি প্রায় পাঁচ হাজার টাকা করে নিত। আর এভাবেই তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ- তারাও এ অপকর্মটি করত। এর মালিক মো. সাহেদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ প্রতিদিন মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে, তা অবাক করার মতো। চেক মামলায় ২০১০ সালে তার ছয় মাসের জেল হয়েছিল (প্রথম আলো)। কিন্তু পুলিশের নাকের ডগার উপর দিয়ে তিনি একাধিক টিভি টকশোতে অংশ নিতেন। এটা কীভাবে সম্ভব ছিল? কেন পুলিশ আদালতের আদেশ পালন করল না? মজার ব্যাপার, যেসব টিভি চ্যানেল তাকে টকশোতে আমন্ত্রণ জানাত, তারাই এখন তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করছে। র‌্যাব তাকে ‘প্রতারক’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। মিডিয়া তাহলে আগে জানত না কেন তার আসল পরিচয়? জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে ডা. সাবরিনার পরিচয় দেয়া হলেও এখন ডা. সাবরিনা জানিয়েছেন জেকেজির সঙ্গে তিনি জড়িত নন। ইতালি থেকে যাদের ফেরত পাঠানো হয়, তাদের মাঝে কেউ কেউ এ জেকেজি’র ভুয়া সনদধারী কোভিড রোগীও থাকতে পারেন! যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা অস্বীকার করেছেন।

একজন সাহেদ কিংবা সাবরিনা-আরিফ জুটি বাংলাদেশের ভাবর্মূতিকে কোথায় নিয়ে গেছে, তা ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তের একটি মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ইতালির ফ্লাইট বন্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরে কন্তে সম্প্রতি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা বেশির ভাগ যাত্রীর মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা’ (ইত্তেফাক, ১১ জুলাই)। কী সাংঘাতিক কথা! একেকজন বাংলাদেশি ভাইরাস বোমা! কন্তে একটি প্রশ্ন তুলেছেন- এসব নাগরিক কীভাবে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পার হল, সেটা অবশ্যই ভাবার বিষয়। অথচ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, ইতালির প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কথা বলেননি।

আমাদের ভাবনার জায়গা হল ভুয়া সনদ আর ইমিগ্রেশন পার হওয়ার বিষয়টি। একটি ইতালিয়ান সংবাদপত্রের (Messaggero) প্রথম পাতায় যখন সংবাদের শিরোনাম হয় ‘Dal Bangladesh con test falsi’ (From Bangladesh with fake tests) তখন আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বৈকি। ভুয়া করোনা সনদের কারণে জাপান, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশিদের সেদেশে আপাতত প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে (ডেইলি স্টার, ৯ জুলাই)। রোমের লাজিও অঞ্চলে প্রায় ছয়শ’ বাংলাদেশি করোনা ‘পজিটিভ’ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন- এ অভিযোগ স্বাস্থ্য কাউন্সিলর আলেস্সিও ডি আমাটোর (Wanted in Rome, ৮ জুলাই)। সুতরাং শঙ্কাটা এখানেই। বলা ভালো, ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন। এখন ইতালির ঘটনাবলি যখন বিশ্বের শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোয় ছাপা হয়, তখন আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? শত শত বাংলাদেশি এখন নানা জটিলতায় জড়িয়ে পড়বেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশনের কড়া নজরদারিতে এরা পড়ে যাবেন এখন। তারা বাংলাদেশের কোনো রিপোর্টকেই আর গ্রহণ করবে না। ফলে নতুন নতুন আইন, বিধিনিষেধ আর ডিপোর্টের মুখোমুখি হবেন বাংলাদেশিরা।

করোনাভাইরাসের ভুয়া রিপোর্ট যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে, তখন আরেকটি সংবাদও আমাদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদটি হচ্ছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নোট ভারবালে বহুল আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসায় বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য ‘ডেজিগনেটেড’ বা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল (মানবজমিন, ১৪ জুলাই)। কী সাংঘাতিক কথা! যে হাসপাতালে আইসিইউ ও অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা মানসম্মত ছিল না, সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই হাসপাতালে বিদেশি কূটনীতিকদের চিকিৎসার কথা বলে কীভাবে? এটা কি এক ধরনের দায়িত্বহীনতা নয়? যিনি এ নোট ভারবালটি পাঠিয়েছিলেন, তিনি কি বাংলাদেশের ভাবর্মূতি নষ্ট করেননি?

করোনা সংকট আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করাও দরকার, যারা দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই।

একজন ডা. সাবরিনা কিংবা মো. সাহেদ আমাদের অনেক ক্ষতি করেছেন। ডা. সাবরিনার জন্য আমার দুঃখ হয়। এমনিতেই বাংলাদেশে হার্টের সার্জনের সংখ্যা কম। মহিলা হার্ট সার্জন নাকি মাত্র তিন থেকে চারজন (বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডাক্তারের মতে)। সুতরাং ডা. সাবরিনা নিজের পেশার প্রতি যদি আরও যত্নবান হতেন, তিনি এদেশের একজন শীর্ষ হার্ট সার্জন হতে পারতেন। অধিক অর্থের লোভে তিনি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিদেশে ডাক্তারদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। ডা. সাবরিনার ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া উচিত। একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত। তা না হলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে।

রিজেন্ট হাসপাতালের ঘটনাবলি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর পরস্পর পরস্পরকে অভিযুক্ত করেছে। মন্ত্রী বলেছেন, তিনি সবকিছু জানতেন না। কেন স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন, এর একটি ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। তাতে বলেছেন, সেখানে তিনি অন্য একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন এবং মহাপরিচালকের অনুরোধে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। এর পেছনে হয়তো সত্যতা আছে। কিন্তু তার মন্ত্রণালয়কে ঘিরে যদি কোনো ‘অন্যায়’ হয়, তার দায়দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না। তার একটি দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল- তাতে তিনি ব্যর্থ। আর অতি ক্ষমতাবান মহাপরিচালক তার দায় এড়াবেন কীভাবে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘিরে টেন্ডারবাজির কাহিনী তো অনেক পুরনো। আফজাল আর মিঠু কাহিনী তো সবার মুখে মুখে। সামান্য কেরানি হয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আফজাল ও তার স্ত্রীর ঢাকা শহরে পাঁচের অধিক বাড়ি থাকা, অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি কেনার কাহিনী অনেকটাই প্রমাণিত। আফজাল বরখাস্ত হয়েছেন। দুদক তাকে নোটিশ করেছে- এসব খবর আমরা জানি। কিন্তু তার অবৈধ অর্থ কি উদ্ধার করা গেছে? একজন কেরানি ছিলেন তিনি। কিন্তু সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী তিনি ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক! এ অবৈধ অর্থ উদ্ধার করা প্রয়োজন।

রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে এসব দুষ্কৃতকারী বারবার পার পেয়ে যায়। অতীতে সম্রাট, পাপিয়া, জেকে শামীম এবং তাদের কুকীর্র্তির কথা আমরা সবাই জানি। কীভাবে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া যায়- এরা একেকজন তার একেকটা উদাহরণ। দুর্নীতিকে তারা একধরনের ‘শিল্পে’ পরিণত করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সাহেদ, সাবরিনা আর আরিফের জন্ম। সাহেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য বলে নিজেকে পরিচয় দিতেন এবং এই পরিচয়েই টকশোতে অংশ নিতেন। ওই উপকমিটির চেয়ারম্যান হচ্ছেন রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির। আজ তথ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনি (সাহেদ) আওয়ামী লীগের কেউ নন। কিন্তু মোহাম্মদ জমির ও সাহেদ একসঙ্গে টকশো করেছেন (মোহনা)। কই সেদিন তো এর প্রতিবাদ হয়নি? একটা দলে বহিরাগত (‘কাউয়া’) থাকতেই পারে। অতীতেও ছিল। এখনও আছে। এটা স্বীকার করে নিয়ে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াই উত্তম।

ভুয়া করোনা সনদের কারণে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন কীভাবে আমাদের ভাবমূর্তি উদ্ধার করা যায়, সে ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বড় উদ্যোগ নিতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। আর অভ্যন্তরীণভাবে এসব ‘প্রতারক’ চক্রের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া উচিত। র‌্যাব অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছে। স্বাধীনভাবে র‌্যাবকে কাজ করতে দেয়া উচিত। র‌্যাবের উচিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও ‘শুদ্ধি’ অভিযান চালানো। যারা একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে (জেকেজি) করোনা টেস্টের স্যাম্পল সংগ্রহ করার অনুমতি দেয়, তারাও সাহেদের মতো অপরাধী। আমরা এখনও এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। করোনাকে আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি বলে মনে হয় না। মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না। এরই মাঝে সাহেদ, সাবরিনা ‘কাহিনী’ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এসব অপরাধীর বিচারের ব্যাপারে আইন বড় দুর্বল। আইনে সংস্কার প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে একটি দ্রুত বিচার আদালত প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্য খাতে যারা দুর্নীতি করেছে, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, তাদের দ্রুত বিচার হওয়া প্রয়োজন।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

সুত্রঃ যুগান্তর