পরীক্ষা কম সংক্রমণ বেশি

দেশে করোনা পরীক্ষার হার কমলেও সংক্রমণের হার রয়েছে আগের মতোই। ক্ষেত্রবিশেষ সংক্রমণের হার কিছুটা বেশি।

বন্যা, নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ, সরকারিভাবে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা না করার সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা এবং টেস্ট সংক্রান্ত নানা জটিলতার কারণে বেশির ভাগ মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

বন্যাক্রান্ত ১৮ জেলার মানুষের করোনার নমুনা পরীক্ষায় কোনো আগ্রহ নেই। পরীক্ষা ছাড়াই প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে সংক্রমিত মানুষ সবার মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের অজান্তেই সুস্থ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে রোগটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সময় দেশে পরীক্ষা বেশি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু পরীক্ষার হার অপেক্ষকৃত কমেছে। অথচ সংক্রমণ আগের গতিতেই চলছে, যা উদ্বেগজনক।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ  এ প্রসঙ্গে বলেন, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, দুর্বিপাক বাংলাদেশ ছাড়ছেই না। একে তো করোনা মহামারী তার ওপর বন্যা। সব মিলিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বন্যার কারণে দেশের বিপুল অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সেসব এলাকার মানুষের কাছে এখন করোনার চেয়ে বন্যার পানি ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে। তাই তারা নমুনা পরীক্ষা করতে পারছে না। অন্যদিকে নানা কারণে লোকজন পরীক্ষা করাতে আগের মতো আগ্রহী না থাকায় পরীক্ষার হার কিছুটা কমেছে। তবে সংক্রমণের হার কমেনি। তিনি বলেন, বন্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে যেন আশ্রয়কেন্দ্রে রোগটি ছড়িয়ে না পড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জুলাই মাসে নমুনা পরীক্ষার হার কমলেও সংক্রমণের হার প্রায় ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ এই সময়ে গড়ে প্রতি ৪ থেকে ৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করলে একজনের দেহে ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ডওমিটার্সের তথ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভাইরাস আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে আট নম্বরে এবং এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, উচ্চ সংক্রমণের মধ্যে যখন পরীক্ষা বেশি হওয়ার কথা তখন জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে পরীক্ষার পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মার্চে প্রথম করোনা শনাক্তের মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫০টিরও কম পরীক্ষা হয়েছে।

এপ্রিল মাসে গড়ে প্রতিদিন পরীক্ষা হয়েছে ২ হাজার ১০২টি, মে মাসে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৭৯টি এবং জুন মাসে গড়ে প্রতিদিন ১৫ হাজার ২৫১টি পরীক্ষা করা হয়েছে। জুন মাসে একদিনে সর্বোচ্চ সাড়ে আঠারো হাজার পরীক্ষা করার তথ্যও রয়েছে।

অথচ জুলাই মাসে পরীক্ষার সংখ্যা কমে দৈনিক এগারো হাজারে নেমেছে। জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে গড়ে ১৪ হাজার ২৮০টি নমুনা পরীক্ষা হলেও গত সপ্তাহে দেখা গেছে, একদিনে নমুনা পরীক্ষা সর্বনিু ১১ হাজারের কাছাকাছি নেমেছে। বিশ্বে প্রতি মিলিয়ন মানুষের মধ্যে পরীক্ষার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮। দক্ষিণ এশিয়ায় ৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৭ নম্বরে আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ৬ নম্বরে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, গত মার্চ মাসে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫১ জন। ওই সময়ে এ রোগে মৃত্যু হয় ৫ জনের। এপ্রিল মাসে শনাক্ত হন ৭৬১৬ জন এবং মৃত্যু হয় ১৬৩ জন। মে মাসে শনাক্ত হন ৩৯ হাজার ৪৮৬ জন এবং মৃত্যু ৪৮২ জন। জুন মাসে শনাক্ত হন ৯৮ হাজার ৩৩০ জন এবং মৃত্যু ১১৯৭ জন। জুলাই মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৬১ হাজার ৯৭০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৮২১ জন।

দেশের ৮টি বিভাগে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ১৫ হাজার ৪৬৮টি। যার মধ্যে ১১ হাজার ৬৯টিই খালি রয়েছে। একইভাবে আইসিইউ শয্যা আছে ৫৩৫টি এবং খালি আছে ২৫২টি। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় এখন হাসপাতালেও রোগীর ভর্তির হার অনেক কম।

এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন-নিপসমের ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামালউদ্দিন সাইফ  বলেন, পরীক্ষার হার কমার অন্যতম কারণ ফলোআপ নমুনা পরীক্ষা না করা সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনা। ফলে যাদের কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ছে নিয়মানুযায়ী তাদের ১৪ দিন পর যে ফলোআপ পরীক্ষা করা হচ্ছে না। এতে আশঙ্কাজনক হারে পরীক্ষা কমেছে।

এছাড়া নতুন রোগীদের পরীক্ষা করাতে যে ২শ’ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে সে কারণেও নমুনা পরীক্ষা কিছুটা কমেছে। বেসরকারি ল্যাবগুলোর নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে। এছাড়া প্রায় ৫ মাস ধরে দেশে করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় সাধারণ মানুষের মনে করোনাভীতি অনেকটাই কমে এসেছে। তারা নমুনা পরীক্ষাকে ঝামেলা মনে করছে। তাদের মাঝে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে অনীহা তৈরি হয়েছে।

একই কারণে হাসপাতালমুখীও হতে চাচ্ছে না তারা মনে করছেন হাসপাতালে যথাযথভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। সেখানে চিকিৎসক নার্সরা রোগীর খবর সেভাবে রাখেন না। কাজেই তারা হাসপাতালের চেয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নেয়ায় বেশি আগ্রহী।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, শহর বা গ্রামে হাসপাতালে গিয়ে কিংবা বাড়িতে ডেকে নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। খোদ ঢাকাতেই বাড়িতে ডেকে নিয়ে নমুনা দেয়ার পরিমাণ কমেছে। বাসায় গিয়ে নমুনা দেয়ার কথা বললেও অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

বন্যা দেখা দেয়ার পর থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তারা করোনার চেয়ে বন্যা থেকে নিজেদের পরিবার জমি ফসল রক্ষায় বেশি ব্যস্ত। এখন পানি কমতে থাকায় বন্যা উপদ্রুত বিভিন্ন এলাকায় নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।

এ সময় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধেও বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ এসেছে। চলতি মৌসুমে তিন সপ্তাহের মধ্যে দুই দফা বন্যার মুখোমুখি হয়েছে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চল। ১৮ জেলার নিম্নাঞ্চলে প্রায় ২৬ লাখ মানুষ দুর্গতিতে পড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, ৩০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত উপদ্রুত এলাকায় ডায়রিয়া, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ, শ্বাসনালির প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৪ হাজার ২৪ জন। এই তিন সপ্তাহে পানিতে ডুবে, ডায়রিয়ায়, সাপের কামড়ে ও বজ পাতে ৬৭ জনের মৃত্যুর তথ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নথিভুক্ত হয়েছে।

মহামারীকালে এই বন্যায় দুর্গত এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অনেক মানুষকে রাখতে হচ্ছে। আবার ত্রাণ নিতেও মানুষে ভিড় হবে। এর মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ থাকলে বা অসচেতন হলে সংক্রমণের নতুন ঝুঁকি তৈরি হবে বলে সতর্ক করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, পানিবন্দি মানুষগুলো হয়তো কম বের হচ্ছে। কিন্তু ত্রাণ শিবিরে লোক জড়ো হচ্ছে। বাইরে থেকে ত্রাণ বিতরণ কর্মীরা আসছে। সীমিত পরিসরে হলেও তাদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ থাকলে ছড়ানোর আশঙ্কা থাকেই। এটা উভয়পক্ষকে নজরে রাখতে হবে। তারা বলছেন, পানিবন্দিদের উপসর্গ তদারকির ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাতে কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের মাধ্যমে সংক্রমণ ঠেকানোর সুযোগ থাকবে।

আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ শিবিরে যারা আসা-যাওয়া করবেন, তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। আবার আশ্রিতদের অবস্থানও ঝুঁকিমুক্ত রাখার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারও মধ্যে উপসর্গ দেখা গেলে বা সংক্রমণ ধরা পড়লে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বা অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডা. আয়েশা আক্তার  বলেন, দেশের ১৮টি জেলা প্লাবিত হওয়ায় সেসব এলাকার মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতে পারছে না। তাছাড়া এখন করোনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করার পর যাদের প্রয়োজন নেই তারা পরীক্ষা করা থেকে বিরত থাকছে। তবে পরীক্ষা দৃশ্যত কম মনে হলেও কম হচ্ছে না।

 

সুত্রঃ যুগান্তর