পরিকল্পনায় শহীদ মিনার থাকে না

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বয়স ৭৮ বছর। ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ে এখনো কোনো শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। ১৯৯১-৯২ সালে বিদ্যালয়টির বড় ধরনের সংস্কার হয়। তখনো করা হয়নি শহীদ মিনার।

স্থানীয় বাসিন্দারা স্কুলের পাশে কাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে ভাষাশহীদদের স্মরণ করে।

একই অবস্থা জেলা সদরের খানপাড়ার ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ১৯৬৮ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখনো সেখানে শহীদ মিনার করা হয়নি। এই জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে এক হাজার ২৪০টি। এর ৩০০ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার আছে।

শিক্ষার আঁতুড়ঘর প্রাথমিক বিদ্যালয়। পারিবারিক গণ্ডির বাইরে এখানেই শিশুর মনন তৈরি হয়। শিশুদের মনোজগতের বিকাশের সময়টায় শহীদ মিনার তার ভাষার প্রতি মমত্ববোধ ও দেশপ্রেম তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

এ অবস্থায় বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তাবনা (ডিপিপি), দরপত্র ও কার্যাদেশ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব বিদ্যালয় নির্মাণ পরিকল্পনায় শহীদ মিনার রাখা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত এ কারণেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় ঠিকমতো শহীদ মিনার থাকে না।

গত দুই বছরে কুড়িগ্রাম জেলায় একজন ঠিকাদার ১২টি বহুতল প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘দুই বছরে ১২টি প্রাথমিক স্কুল নির্মাণ করেছি। কিন্তু দরপত্র বা কার্যাদেশে শহীদ মিনার নির্মাণ করার কথা ছিল না। লাখ দুয়েক টাকা হলেই বিদ্যালয়ের কাজের সঙ্গে ভালো মানের শহীদ মিনার বানানো সম্ভব। ’

শহীদ মিনার নির্মাণে প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কর্তৃপক্ষের ওপর সরকারি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই তাগিদ নেই স্কুল কর্তৃপক্ষেরও। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্কুল চত্বরে শহীদ মিনার নির্মাণের মৌখিক নির্দেশনা থাকে। যদিও তা বাধ্যতামূলক নয়।

সর্বশেষ ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাসিক সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, সারা দেশে অভিন্ন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম সেদিন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘শহীদ মিনার নির্মাণের বিষয়টি আমরা স্কুল ম্যানেজিং কমিটির ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। এতে যার যেমন খুশি তেমন নকশা করে তারা বানিয়েছে। সে কারণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নকশা করে সব স্কুলে পাঠানো হবে। একই রকম শহীদ মিনার যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে করা হয়, সে নির্দেশনা নেওয়া হবে। ’

আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম গত বছর গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সারা দেশে প্রায় ২০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার আছে। সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৬২০টি।

সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করে একনেকে পাঠায় পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। কেন ডিপিপিতে বিদ্যালয় নির্মাণের সঙ্গে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা থাকে না, জানতে চাইলে এই বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এমন কোনো প্রকল্প আসেনি। তবে অবশ্যই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার নির্মাণ জরুরি। যেহেতু শহীদ মিনার নির্মাণ করতে খুব বেশি জায়গার দরকার হয় না, তাই স্কুল প্রাঙ্গণে এই শহীদ মিনার নির্মাণ পরিকল্পনায় রাখা যায়। ’

দেশের বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার না থাকা পরিকল্পনার ব্যর্থতা বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘শহীদ মিনারের সঙ্গে জড়িত আছে ১৯৪৮, ১৯৫২-এর ইতিহাস। আমরা যদি শিশুদের শিক্ষাজীবনের শুরুতে এই অর্জনগুলো জানাতে পারি, তাহলে তারা কখনো হীনম্মন্যতায় ভুগবে না। ’

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ