পরনের কাপড় ছাড়া সবই নিয়ে গেছে নদী যমুনা

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যমুনার তীরবর্তী শতাধিক বাড়ি নদীর পানিতে বিলীন হয়ে গেছে।

এতে নিমিষেই গ্রামবাসীর বসতবাড়ি, ফলের গাছ, ঘরের তৈজসপত্র, বিছানা-বালিশ নদীতে ভেসে যায়। অনেকের হাঁস-মুরগিও নদীতে ভেসে গেছে। কেউ কেউ পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই নিতে পারেনি।

উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের ইছামারা এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের পুরাতন বাঁধের পূর্বপাশে বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) বিকেল ৪টার দিকে আকস্মিক এই ভাঙন দেখা দেয়। মাত্র ৩০ মিনিটের ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন নদীপাড়ের মানুষরা। এরপর সহস্রাধিক পরিবার তাদের বাড়িঘর সরিয়ে ফেলেন।

স্থানীয়রা জানান, ইছামারা মোড় থেকে একটি বাঁধ পূর্ব যমুনা নদীর দিকে প্রায় ৫০০ মিটার বিস্তৃত ছিল। গত ২৫ বছর আগে এই বাঁধের পাশে কয়েকশ পরিবার বসতি গড়ে তোলেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে হঠাৎ করে যমুনার তীব্র স্রোতের কারণে বাঁধ ভাঙতে শুরু করে। এরপর বাড়িঘর চোখের পলকে পানির নিচে তলিয়ে যায়। ফলে তারা বাড়ি ঘর এবং ঘরের মধ্যে থাকা জিনিসপত্র কিছুই রক্ষা করতে পারেনি।

এর আগে বুধবার (৩০ আগস্ট) দুপুর থেকে যমুনা নদীর পানি সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর চলে যায়। এতে বগুড়ার তিন উপজেলা সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনটের চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঢলের পানির স্রোতে একটি স্পার বাঁধের প্রায় ২০ মিটার ধসে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারিয়াকান্দী উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের ইছামারা, টিটুরমোড়, ফকিরপাড়া, খোকার মোড় এলাকা এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই হুমকির মুখে পড়ে। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন প্রতিরোধে জিও ব্যাগ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিল। সম্প্রতি যমুনা নদীর পানি ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ভাঙন তীব্র হয়ে ওঠে।

ইছামারা গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর আব্দুল বাছেদ জানান, যমুনার তীরে তার দুটি ঘর ছিল। চোখের সামনে ঘরগুলো নদীতে চলে যেতে দেখেছেন তিনি। ঘরের ভেতর থেকে বিছানা-বালিশ কিছুই নিতে পারিনি। পালন করা ছাগলগুলো কোথায় তাও জানেন না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোথায় থাকবেন এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, নদী ভাঙন দেখা দেওয়ার পরেও কামালপুর ইউনিয়নের ভাঙন এলাকায় ঠিকাদাররা ধীর গতিতে কাজ করেছে। প্রথম থেকে দ্রুত কাজ করলে এমনটি হতো না। মাত্র ৩০ মিনিটে চোখের সামনে নদী সব ভেঙে নিয়ে গেল।

শাহানাজ বেগম নামে এক গৃহবধূ জানান, প্রায় দুই যুগ ধরে এখানে বসবাস করছেন তিনি। প্রতি বছর যমুনা সময় দিলেও এবার তাদের কোনো সময় দেয়নি। পরনের কাপড় ছাড়া তাদের অনেকেরই এখন কিছুই নেই।

তিনি বলেন, এখানে অনেকেই ৫-৭ বছর ধরে বসবাস করছিলেন। কারও একটি, কারো বা দুটি, আবার কারোর তিনটি ঘর যমুনায় চলে গেছে। অনেকের ঘরের অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে ফার্নিচার ছিল। কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। মুদি দোকান ঘরের সমস্ত পণ্য হারিয়েছে দোকানিরা।

এদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা বর্তমানে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস, জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

জানা যায়, যমুনা নদীর অংশের নিচু এলাকার বসতবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী, কর্নিবাড়ী, বোহাইল, কাজলা, চন্দনবাইশা, সারিয়াকান্দি সদর, হাটশেরপুর, কুতুবপুর, ও কামালপুর ইউনিয়নের প্রায় ১২২টি চরের বাড়িঘরে পানি উঠেছে।

সোনাতলা উপজেলার তেকানী-চুকাইনগর ও পাকুল্যা ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের মধ্যে রয়েছে চুকাইনগর, ভিকানের পাড়া, মোহনপুর, সরলিয়া, খাবুলিয়া, খাটিয়ামারি, সুজাইতপুর, রাধাকান্তপুর, আচারের পাড়া, পূর্ব সুজাইতপুর। এছাড়া ধুনটের অল্প কিছু যমুনা নদীর অংশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ গবাদি পশু, ফসল নিয়ে এখনও চরের মধ্যে আছেন। তাদের আবাদ করা রোপা আমন, মাশকলাই, মরিচ, স্থানীয় জাতের গাঞ্জিয়া ধানসহ অন্যান্য ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি দীর্ঘস্থায়ী হলে এসব ফসল সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চরের বাসিন্দারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বগুড়াতে মোট ৪৫ কিলোমিটার নদীর তীর। এর মধ্যে ১৯ কিলোমিটার পর্যন্ত ব্লক দিয়ে পার্মানেন্ট কাজ করা আছে। এই ১৯ কিলোমিটারে ভাঙন নেই। যে জায়গাগুলো অরক্ষিত আছে সেখানেই গিয়ে পানি চলে যাচ্ছে। বাকিগুলো করার জন্য একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে দেওয়া আছে। ওটা পাশ হলেই বাকিগুলোও করা হবে।

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হুমায়ন কবির জানান, যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে সারিয়াকান্দির হাসনাপাড়া স্পার হুমকির মুখে পড়েছে। স্পারের তলদেশ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় ৬৫ ফুট মাটির স্যাংক দেবে গেছে। স্পারের দেবে যাওয়া অংশে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করা হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্ষার শুরু থেকে কামালপুর ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪টি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ঠিকাদার কাজ করছিলেন। সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলের বন্যায় হঠাৎ করে বেড়ে যায় ভাঙন। ভাঙন প্রতিরোধে আমরা বালুভর্তি জিও টিউব ব্যবহার করছি। আমাদের পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ মজুদ আছে। আমরা ফেলছিও। কিন্তু পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার পর হঠাৎ করে ম্যাসিভ আকার ধারণ করলো। বিগত ১০ বছরেও এরকম নদী ভাঙন এলাকাবাসী দেখেনি।

কামালপুর ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদুজ্জামান রাসেল জানান, ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। একশরও বেশি বাড়ি এক নিমিষে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসময় কোনোমতে সেসব বাড়ির লোকজন বের হয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু তাদের বাড়ির কোনো জিনিসপত্রই তারা রক্ষা করতে পারেনি। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে ওইসব পরিবার।

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সবুজ কুমার বসাক বলেন, আমরা সবাইকে অবহিত করেছি। ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে উদ্ধার কাজ শুরু করেছি। এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

বগুড়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, যমুনা নদীতে বিপৎসীমা নির্ধারণ করা হয় ১৬ দশমিক ২৫ মিটার। শুক্রবার (০১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টার হিসেব অনুযায়ী নদীর পানি ১৬.৩৯ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অর্থাৎ বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে জেলার বাঙ্গালী নদীতে বিপৎসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫.৪০ মিটার। এ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ১৪.৪৮ মিটার হলেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানান, যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ১৫ হেক্টর আমন (স্থানীয় জাতের গাইঞ্জা ধান), ২ হেক্টর বীজতলা ও ১ হেক্টর সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।