নিরবে রাজশাহীর অসহায় শিল্পীদের পাশেও ছিলেন এন্ড্রু কিশোর, ছিলো আরও স্বপ্ন

কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন এন্ড্রু কিশোর। রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে এগিয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। দাঁড়াতেন অসহায় শিল্পীদের পাশে। শিল্প-সংস্কৃতির কেউ মারা গেলে তাঁর পরিবারকে অন্তত ১০ হাজার টাকা দিতেন। নিজে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে হেরে গেছেন। তবে জীবিত থাকাকালে অন্য ক্যান্সার রোগীদের লড়াইয়ের রসদ জুগিয়ে দিয়েছিলেন।

তাঁদেরই একজন ওস্তাদ বদিউজ্জামান। এই সংগীতশিল্পীর চিকিৎসার জন্য দুই বছর আগে নিজের সংগঠন ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’-এর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে আরেক ক্যান্সার আক্রান্ত অসহায় বংশীবাদক শিবনাথ দাসের চিকিৎসার জন্য দিয়েছিলেন ৭০ হাজার টাকা। এসব সমাজকর্মের কথা প্রচার হোক, তা কখনোই চাননি এন্ড্রু কিশোর।

রাজশাহীর যেসব বন্ধু ও সংগীতপ্রেমী মানুষের সঙ্গে তিনি মিশতেন, তাঁদের মতে, বরেণ্য এই শিল্পী একেবারেই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। কখনোই নিজের সুখের জন্য বিলাসিতার পথে হাঁটেননি। ঢাকায় বা দেশ-বিদেশে যত ব্যস্তততার মধ্যেই থাকতেন না কেন, মাসে-দুই মাসে তিনি রাজশাহীতে নিজের মানুষদের কাছে ফিরতেনই।  এখানকার অসহায় শিল্পী, অসহায় মানুষ এবং পিছিয়ে পড়া উপজাতিদের কথা ভাবতেন রাত-দিন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে এগিয়ে নিতে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। জীবনের শেষ সময়টুকু রাজশাহীতেই কাটাতে চেয়েছিলেন। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে যখন জানতে পারেন, আর বেশি দিন বাঁচবেন না, তখনই রাজশাহীতে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। ১১ জুন দেশে ফিরেই ছুটে আসেন রাজশাহী।

রাজশাহী নগরীর রানীবাজারের বাসিন্দা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শরিফুল আলম বাবু ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিশোরের। ১৯৭৯ সাল থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব। কিশোরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই সম্পর্কে কখনো চিড় ধরেনি। শেষদিন পর্যন্ত বন্ধুর পাশে থাকার সুযোগ হয়েছে বাবুর।

তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পীদের জন্য অনেক করেছেন কিশোর। তাঁর সংগীতগুরুর নামে গড়ে তোলা সংগঠনের ব্যানারে প্রথম দিকে আমরা প্রতি মাসে গানের আসর বসাতাম। প্রতিভাবান শিল্পীরা সেখানে গাওয়ার সুযোগ পেতেন। এরপর কিশোরের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেটি প্রতি তিন মাসে একবার আয়োজিত হতো। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলত।’

বাবু আরো জানান, নিজের ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর স্মৃতি লালন করার জন্য বাচ্চু স্মৃতি সংসদ গড়ে তোলেন কিশোর। সংগঠনটির অফিস ভাড়াসহ যাবতীয় খরচ একাই বহন করতেন এন্ড্রু কিশোর। রাজশাহীর কোনো শিল্পী মারা গেলে এই সংগঠনের ব্যানারেই তাঁদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া শীতবস্ত্র বিতরণ থেকে শুরু করে বন্যার্তদের মাঝে   সাহায্য প্রদানসহ অনেক মহৎ কাজ করে সংগঠনটি। এর বেশির ভাগ অর্থ দিতেন কিশোর। রাজশাহী অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন কিশোর। গোপনেও অর্থ সহায়তা দিতেন তিনি। অনেক সময় দরিদ্র মানুষ মুখ ফুটে সাহায্য চাইতেন না, কিশোর তাঁদের চোখের ভাষা বুঝে নিতেন। সহজেই তিনি মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। কখনোই     কাউকে ছোট করে কথা বলতেন না।

এন্ড্রু কিশোরের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুরকার ও গীতিকার ইথুন বাবু। রাজশাহীর শিল্পীদের সহযোগিতা করার কথা বললেন ইথুন বাবুও, ‘রাজশাহী সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে টেনে তুলতে কিশোর যে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, সেটা এখানকার মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে।’ ইথুন বাবু আরো বলেন একটি বৃদ্ধাশ্রমের কথা, ‘রাজশাহীর নওহাটা এলাকায় কিশোরের বোনজামাই প্যাট্রিক বিশ্বাসের উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে একটি বৃদ্ধাশ্রম। সেখানেও সহযোগিতা করেছেন কিশোর।’

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানালেন প্যাট্রিক বিশ্বাস, “বৃদ্ধাশ্রমটির নাম ‘সার্ভিস সেন্টার ফর এলডারলি পিপলস’। সাত বিঘা জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে এটি।  এই প্রকল্পের ৬৫ জন আজীবন সদস্যের একজন এন্ড্রু কিশোর। লায়লা রওশন নামের এক নিঃসন্তান নারী বৃদ্ধাশ্রমের জন্য এই জমি দিয়েছেন আমাদের। প্রকল্পের চারপাশে সীমানা দেয়াল তৈরির অর্থের জোগানও দিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। এখানে ১০ জন বৃদ্ধ থাকতে পারবেন। এর মধ্যে ৭৫ জন থাকবেন বিনা মূল্যে, অর্থের বিনিময়ে থাকার সুযোগ পাবেন বাকি ২৫ জন।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং নাট্যকার মলয় ভৌমিকও কিশোরের বন্ধু। রাজশাহীতে কোথাও কিশোর গাইতে গেলে শো উপস্থাপনা তিনিই করতেন। মলয় ভৌমিক বলেন, ‘খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমাদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে আমরা একসঙ্গে মাস্টার্স পাস করেছি। অনেক সময় কোনো স্টেজ শোর পরিকল্পনা চলাকালে তিনি জানতে চাইতেন, উপস্থাপনা কে করছে? তখন তিনি আমার নাম প্রস্তাব করতেন।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘এন্ড্রু কিশোর চলে যাওয়ায় সত্যিকার অর্থেই অনেক ক্ষতি হয়ে গেল সংগীতের। গণমানুষের জন্য সংগীতের যে চর্চাটা ছিল সেটা তাঁর হাত দিয়ে শুরু হয়েছিল।’

রাজশাহী থিয়েটারের সভাপতি কামারুল্লাহ সরকার বলেন, ‘রাজশাহীতে নিয়মিত সংগীতায়োজনের উদ্যোগ নিতেন তিনি। সব শিল্পীকে একত্র করার চমৎকার একটা উদ্যোগ ছিল এটা।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ