‘নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের মূল কারণ তিনটি’

লিকেজ হওয়া মিথেন গ্যাস, আবদ্ধ (এয়ার টাইট) কামরা আর বৈদ্যুতিক লাইনের চেঞ্জ ওভার- এ তিনটি বিষয়কেই নারায়ণগঞ্জের তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদের ভয়াবহ সেই বিস্ফোরণের নেপথ্য কারণ বলে উপনীত হয়েছে ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটিগুলো।

তিতাস, ফায়ার সার্ভিস, ডিপিডিসি ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত চারটি তদন্ত কমিটির নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। মূলত এই তিনটি মূল কারণ ব্যতীত আগুনের অন্য কোনো সূত্র বা কারণ আপাতত তদন্ত কমিটিগুলোর সামনে উঠে আসেনি।

তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার সঙ্গে মসজিদ কমিটি, ডিপিডিসি ও তিতাস কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও গাফিলতির বিষয়টিও এড়িয়ে যাচ্ছে না কমিটির রিপোর্ট থেকে।

কমিটির সূত্রগুলো বলছে, নাশকতার যেই আশঙ্কা বা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল তদন্তে সেই সমীকরণের কোনো মিল এখনও পাওয়া যাচ্ছে না।

ডিপিডিসির গঠিত তদন্ত কমিটি গত রোববার তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্য ও নির্বাহী প্রকৌশলী (পশ্চিম) আনিসুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, আগুনের মূল কারণ হিসেবে তিতাসের লিকেজ হওয়া গ্যাসকেই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

জানা গেছে, আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়েই গঠিত বাকি তদন্ত কমিটিগুলো তাদের রিপোর্ট স্ব স্ব দফতরে জমা দিতে যাচ্ছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্তে বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকেই আগুনের বা বিস্ফোরণে সূত্রপাত হয়েছে বলে- এমন তথ্যই উঠে এসেছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে ওই কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদন জমা দিতে আরও পাঁচ কার্যদিবস সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

এদিকে তথ্যানুসন্ধানে ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের তদন্তে পাওয়া গেছে- দেড় যুগেরও বেশি আগে পশ্চিম তল্লা জামে মসজিদটির পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। মসজিদে প্রবেশ পথের গেটে একটি কলাপসিবল গেট, দুটি কাচের টানা দরজা ছিল। মসজিদের বারান্দা থেকে ভেতরের অংশ থাই দিয়ে সাঁটানো ছিল। থাই দিয়ে ঘেরা অংশের ভেতরে ১৫টি জানালা, ছয়টি এয়ারকন্ডিশন, ২৬টি সিলিং ফ্যান, ৭০টি সুইচ সকেট ছিল।

তদন্তে আরও উঠে এসেছে- মসজিদের বিদ্যুৎ প্যানেল বোর্ড ও ডিস্ট্রিবিউশনের দুটি লাইন ব্যবহার করা হতো। যার একটি লাইন ছিল বৈধ, অন্যটি অবৈধ। একটি লাইন ম্যানুয়ালি এবং একটি লাইন অটো বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবহার হতো; যা মসজিদ কমিটির সাক্ষ্যসহ অনেকের বক্তব্যেই উঠে এসেছে।

ঘটনার দিন ৪ সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই মসজিদে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। মসজিদের মুসল্লিরা এশার নামাজের ফরজ আদায় করে অনেকে মসজিদ থেকে বের হয়ে যান। আনুমানিক ৮টা ৪৫ মিনিটের সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এ সময় অনেক মুসল্লি সুন্নতসহ অন্যান্য নামাজ আদায় করছিলেন।

মসজিদের মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন এ সময় বিদ্যুতের লাইন চেঞ্জ করতে গেলে স্পার্ক হয়। এ সময় দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় মসজিদে জমে থাকা গ্যাসের কারণে আগুন ধরে যায়। এতে মসজিদের ভেতরে থাকা মুসল্লিদের শরীরে আগুন ধরে যায়।

এছাড়া মসজিদটি যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সেই রাস্তাটি অনেক সরু এবং নিচু এলাকা হওয়ায় দগ্ধ ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলেও তদন্তে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্ত কমিটির প্রধান খাদিজা তাহেরা ববি বলেন, তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। অনেক তথ্য আমরা পেয়েছি। আমরা বিদ্যুৎ, তিতাস গ্যাস, মসজিদ নির্মাণে ত্রুটিসহ সব বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

অপরদিকে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটিতে একই রকম কারণ উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র। ওই সূত্র জানায়, আমরা অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক উপায়ে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার করে এবং বেশ কিছু বিষয় নিরীক্ষণের মধ্য দিয়েই তদন্ত করছি। বিশেষ করে বিস্ফোরণ বা আগুনের ঘটনার পরপরই আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি। সেখানকার পরিস্থিতি খুব ভালোভাবেই নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করেছি।

সূত্র আরও জানায়, তিতাসের লিকেজ হওয়া গ্যাস থেকেই আগুনের ঘটনা ঘটেছিল সেটি প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা দুটি বিষয়েই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম। একটি হল পুরো বিস্ফোরণের এলাকাটিতে অর্থাৎ মসজিদের অভ্যন্তরে কোনো ছাই বা কালো দাগ ছিল না, যেটি গ্যাস থেকে আগুন লাগার কারণেই হওয়া সম্ভব। দ্বিতীয়টি হল পানি জমার কারণে মসজিদের ফ্লোর থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের নির্গমন হয়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, যেহেতু তদন্ত চলছে তাই সরাসরি কোনো মন্তব্য করব না। কিন্তু ঘটনার পর আমরা গ্যাস ডিটেক্টর মেশিনে ওই মসজিদে ১৭ শতাংশ মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব পেয়েছি। যেখানে কোনো বদ্ধ কামরায় ৫ শতাংশ মিথেন গ্যাস ও ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কোনো স্ফুলিঙ্গ পেলে আগুন জ্বলে উঠতে সক্ষম। সেখানে ৬টি এসি চলমান ছিল, ফলে আগুনের ব্যাপ্তি কয়েকশ’গুণ বাড়িয়ে দেয়ার মতো রুম টেম্পারেচার (তাপমাত্রা) ছিল। আবদ্ধ কামরা হওয়ায় সেখানে বিস্ফোরণের আগে আরও কয়েকগুণ বেশি গ্যাস ছিল। ওই অবস্থায় বৈদ্যুতিক স্পার্কের ফলেই ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ হয়েছে বলে আমাদের অনুসন্ধানে এখনও পর্যন্ত ধরা পড়েছে।

এদিকে তিতাস ও ডিপিডিসির তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বললে তারাও প্রায় একই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিতাস গ্যাসের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) আবদুল ওয়াহাব তালুকদার জানিয়েছেন, আমরা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৪ কার্যদিবস বাড়িয়েছি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে।

তদন্তে তিতাসের কারও গাফিলতি থাকলে সেটি অবশ্যই প্রতিবেদনে দেয়া হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, অনেক মানুষ মর্মান্তিকভাবে মারা গেছেন। অনেক পরিবারের কান্না থামছে না। আমরা অত্যন্ত পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্ত করছি, দোষী কাউকেই বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না। তবে তিতাসের তদন্তে লিকেজ হওয়া গ্যাস ও বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকেই আগুন বা বিস্ফোরণে মূল কারণ বলে অনেকটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।

এদিকে ডিপিডিসির গঠিত তদন্ত কমিটি গত রোববার তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন কমিটির সদস্য ও নির্বাহী প্রকৌশলী (পশ্চিম) আনিসুর রহমান। তিনি জানিয়েছেন, আগুনের মূল কারণ হিসেবে তিতাসের লিকেজ হওয়া গ্যাসকেই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তবে বিদ্যুতের লাইন চেঞ্চওভার করতে গিয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল কিনা সেই বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।