নানা প্রতিকুলতায়ও অদম্য ওরা

মো. মঞ্জুরুল আলম মাসুম, বাগাতিপাড়া:
রডমিস্ত্রি বাবা শ্রমিকের কাজে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। সেই থেকে নানার বাড়িতে থেকে সেলাইয়ের কাজ আর ছাগল-মুরগী পালন করেন বিধবা মা। সে আয়েই চলে একমাত্র মেয়ে তোন্নিমা খাতুনের পড়াশোনার খরচ। বেসরকারী স্কুলে দপ্তরী পদে চাকরি করে সামান্য টাকায় সংসার চালিয়ে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খান বাবা। সময়মতো বই-খাতা কিনতে পারেনি। তবুও বড় হওয়ার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করেছে ফাতেমা খাতুন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি দরিদ্র বাবা-মার সংসার চালিয়ে মেয়ের পড়া-লেখার খরচ চালাতে পারেনি। তাই মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে খাদিজা আক্তার রিমা। এভাবেই তিলে তিলে সীমাহীন কষ্টে বেড়ে উঠলেও দারিদ্র্যতার কাছে হার মানেনি নাটোরের বাগাতিপাড়ার তিন অদম্য মেধাবী।

তোন্নিমা খাতুন:
উপজেলার চিথলিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে তোন্নিমা। চার বছর বয়স যখন, তখনই ছোট ভাই মীমকে পানিতে ডুবে এবং একই বছর রডমিস্ত্রি বাবা তজিবরকে হারায় তোন্নিমা। শ্রমিকের কাজে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা যান তার বাবা। সে সময় চিথলিয়া হিন্দুপাড়া গ্রামের পৈতৃক ভিটা হারিয়ে একই গ্রামের নানা রুস্তম মন্ডলের বাড়িতে মা’সহ আশ্রয় মেলে তার। সেই থেকে একমাত্র সন্তানকে বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন মা জাহানার বেগম। আশ্রয় মিললেও দারিদ্র্যতার কারণে তারাও তেমন সহযোগিতা করতে পারেন না। তাই সেলাইয়ের কাজ আর ছাগল-মুরগী পালন করে যা পান তাই দিয়ে ভরণপোষণসহ মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন তিনি। লেখাপড়া শিখে পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে দেশের সেবা করার স্বপ্ন তোন্নিমার দু’চোখ জুড়ে। কিন্তু এতদিন বাড়ির পাশের স্কুলে লেখাপড়া করলেও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের আকাঙক্ষা কিভাবে পূরণ হবে তা জানা নেই অদম্য মেধাবী তোন্নিমার।

ফাতেমা খাতুন:
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলার চিথলিয়া দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে ফাতেমা খাতুন। সে বড় চিথলিয়া গ্রামের দপ্তরী সাইফুল ইসলাম ও নাছিমা বেগম দম্পতির মেয়ে। দুই ভাইবোনের মধ্যে বড় সে। কিন্তু বাবা বেসরকারি স্কুলে দপ্তরীর চাকরি করে কোন মতে সংসার চালান। এর ওপর দুইজনের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ির চার শতাংশ ভিটে ছাড়া কোন জমিজমা না থাকায় সংসারে অভাব-অনটন লেগেই রয়েছে। ভাল কলেজে ভর্তি হয়ে ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন তার। কিন্তু আর্থিক দৈন্যতার কারণে সে স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা তার উত্তর জানা নেই ফাতেমা খাতুনের।

খাদিজা আক্তার:
এক পা নেই, আরেক পা‘ও স্বাভাবিক নয়। বাম হাতের চারটি আঙ্গুল নেই, আর ডান হাতের কব্জী থেকে কনুই পর্যন্ত আঁকা-বাঁকা। আঙ্গুলগুলোও অচল। তবুও কৃত্রিম পায়ে চলা-ফেরা, আর সেই আঁকা-বাঁকা হাত নিয়েই এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সাফল্য অর্জন করেছে খাদিজা আক্তার রিমা। সে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার ফাগুয়াড় দিয়াড় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ ৪ দশমিক ৮৯ পেয়েছে। নাটোর সদরের কদমতলি বাজারের তেঘরিয়ার দরিদ্র লূৎফর রহমান ও হাসি খাতুন দম্পতির মেয়ে খাদিজা আক্তার। দারিদ্রতার কারনে বাবা-মায়ের সংসার চালানোয় দুরহ, সেখানে প্রতিবন্ধী খাদিজার পড়া-লেখা ছিল অনিশ্চিত। তাই ছোট বেলা থেকেই খাদিজা তার নানা আশকান প্রামানিকের বাড়িতে থেকেই পড়া-লেখা করে। নানার বাড়ি বাগাতিপাড়া উপজেলার ফাগুয়াড়দিয়াড়ের জামতলা মোড়ে। ছোট্ট দোকানি মামা তার পড়াশোনার খরচ চালান। কৃত্রিম পায়ে চলাফেরা আর অস্বাভাবিক হাতে লিখতে অসুবিধা হয়। তবুও এগিয়ে যেতে চায় সে। বড় হয়ে সমাজের সেবামূলক পেশায় নিজেকে আত্ম নিয়োগ করতে চায় খাদিজা।

স/শা