বোরো মৌসুম

ধান বেচে উঠছে না উৎপাদন খরচ, দিশেহারা কৃষক

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

এবছরের বোরো মৌসুম ছিল কৃষকদের জন্য সর্বোচ্চ খরচের বছর। সেচযন্ত্রের জ্বালানি ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম রেকর্ড পর্যায়ে। খরার কারণে সেচও লেগেছে অনেক বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি। অথচ সীমাহীন খরচের এই মৌসুম শেষে ধানের কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না কৃষক। উৎপাদন খরচই উঠছে না বলে দাবি তাদের।

সরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এবছর প্রতি মণ বোরো ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকার বেশি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মৌসুমে বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে এলাকাভেদে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০ টাকা (মোটা ধান) দরে। কাঁচা ধানের দাম আরও কম। সরু জাতের ধানের দাম ১ হাজার ১শ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা। এ দামে ধান বিক্রি করে লাভ হচ্ছে না বলে দাবি কৃষকের। গত বছরও এসময় ধানের দাম এর চেয়ে বেশি ছিল।

কৃষকরা বলছেন, গত বোরো মৌসুমে এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১০ থেকে ১১ হাজার টাকার মধ্যে, যা এবছর সেচ, সার, কীটনাশক ও মজুরি বাড়ায় দাঁড়িয়েছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকায়। এর মধ্যে ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচ খরচ বেড়েছে বিঘাপ্রতি প্রায় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। সারের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এছাড়া বীজ ও কীটনাশক কিনতে হয়েছে চড়া দামে। ধান পরিচর্যা, কাটা শ্রমিকের মজুরি, মাড়াই ও পরিবহনসহ অন্য সব ধরনের খরচও বাড়তি। কয়েক দফায় সবকিছুর দাম বাড়লেও ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা। ধান বিক্রি করতে হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে।

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার শান্তা গ্রামের কৃষক এনামুল হক বলেন, সার ও সেচের খরচ বেশি হওয়ায় ধার করে ধান চাষ করতে হয়েছে এবার। বিঘাপ্রতি দুই হাজার টাকা সারের জন্য ও সেচে আরও হাজার টাকা বেশি লেগেছে। এখন ধান বেঁচে সেটা পরিশোধ হচ্ছে না। পাওনাদারের তাগাদায় বাধ্য হয়ে কম দামে বাজারে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ধান কাটতে একজন শ্রমিককে মজুরি দিতে হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। সঙ্গে তিনবেলা খাবার। অথচ এ এলাকায় প্রতি মণ মোটা ধান (কাঁচা) বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়। এত কম দামে ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠছে না। লোকসান হচ্ছে।

পাশের জেলা নওগাঁ সদরের হোগলবাড়ি এলাকার কৃষক হারুনুর রশিদ এবছর ছয় বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেন। সারের দাম বাড়ার পরে খরচ তার কত বেড়েছে সেটার হিসাব রেখেছেন তিনি। হারুন বলেন, এর আগে এক বিঘা জমিতে ধান আবাদে সারের জন্য মোট ২ হাজার ৯৯০ টাকা খরচ হতো। এপ্রিলে সারের দাম বাড়ানোর পর খরচ হচ্ছে ৩ হাজার ৬৪৫ টাকা।

তিনি বলেন, ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি, এমওপি সারের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে এখন বিঘাপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া সার কিনতে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৮০ টাকা, ৩০ কেজি ‍ডিএপিতে ৬৩০ টাকা, ২৫ কেজি এমওপিতে ৪৭৫ টাকা, ২০ কেজি জিপসামে ৭৫০ টাকা, ৩ কেজি ম্যাগনেসিয়ামে ৩৫০ টাকা, ১ কেজি জিংকে ২১০ টাকা এবং ১ কেজি বোরনে ব্যয় হয়েছে ১৫০ টাকা।

ওই জেলার চকপ্রসাদ গ্রামের কৃষক ফিরোজ হোসেন বলেন, আমার জমিতে এবার বোরোর ফলনে বাম্পার হয়েছে। আশপাশের সবারই ফলন ভালো হয়েছে। তারপরেও খরচের কারণে কারও খুশি নেই। কারণ খরচের তুলনায় ধানের দাম বাড়েনি, বরং কমেছে।

তিনি জানান, আবাদের ব্যয় ছাড়াও প্রতি বিঘায় ধান কাটতে খরচ পড়ছে চার হাজার টাকা। জমি থেকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে আরও এক হাজার টাকা এবং ধান মাড়াই করতে খরচ হয়েছে আরও ৫০০ টাকা। ধান রোপণ থেকে শুরু করে ঘরে ওঠানো পর্যন্ত তার খরচ প্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো।

দাম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, গত বছরও মোটা ধানের দাম ১ হাজার ২শ টাকা মণ পেয়েছি। এবার ধান আবাদে খরচ বেশি হলেও দাম ৯৮০ থেকে এক হাজার টাকা মণ চলছে। ধান বিক্রি করে লোকসান হচ্ছে।

রানীনগর আবাদপুকুর গ্রামের বেলু মিয়া বলেন, গরমে চিটা হওয়ার ভয়ে প্রতি দুদিন পরপর সেচ দিতে হয়েছে এবার। সেজন্য খরচ বেড়েছে অনেকটা, যা অন্য বছর হয়নি।

তিনি জানান, তার জমিতে প্রতি বিঘায় সেচ ও চাষ দিতে দরকার হয় প্রায় ২০ লিটার ডিজেল। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এবছর বিঘাপ্রতি ৫০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে।

অন্যদিকে রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ভৈরবসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলেও জানা যায় একই পরিস্থিতির কথা। সবারই খরচ বেড়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় মিলছে না কাঙ্ক্ষিত দাম। এবার অতিখরায় ধানে বাড়তি খরচ হয়েছে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত। আবার খরার কারণে শ্রমিকের মজুরিও বেশি লাগছে। তবে কিছু এলাকা খরার কারণে ধান চিটা হয়ে ফলন কিছুটা কমেছে। আবার উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকায় ব্লাস্ট রোগের কারণেও ধান নষ্ট হয়েছে। তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে আরও বেশি।

রাজশাহীর পবা উপজেলার কৃষক শামসুল হক জানান, এবার ব্রি-২৮ জাতের ধান আবাদ করতে বিঘাপ্রতি তার খরচ হয়েছে ১৪ হাজার টাকা। গরমে কিছুটা চিটা হওয়ায় বিঘাপ্রতি ধানের ফলন পেয়েছেন ১৮ মণ। তবে শ্রমিক খরচ ও পরিবহন মিলে ধানের যে দাম তাতে বিক্রি করে তার লাভ হবে না।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকের পারিশ্রমিক হিসেবে টাকার বদলে ধান দিয়েও পরিশোধ করা যায়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, ছয়-সাতজন শ্রমিক এক বিঘা ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ করে দিলে প্রায় আড়াই মণ ধান দিতে হতো অন্য বছর। এবার শ্রমিকেরা সাড়ে চার মণ চাচ্ছেন। কারণ ধানের দাম কম, শ্রমিকের চাহিদা বেশি। তারপরও ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে উৎপাদিত ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এ বোরো মৌসুম থেকে। এ মৌসুমে দুই কোটি ১৫ লাখ টন চাল উৎপাদন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত হাওর এলাকায় প্রায় শতভাগ ও সারাদেশে প্রায় অর্ধেক ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে।

হাওরের সবচেয়ে বেশি ধান বেচাকেনা হয় ভৈরবের মোকামে। সেখানে শুরুতে ধানের দাম কিছুটা বেশি থাকলেও এখন ক্রমাগত কমছে। ধান ও চালের আড়তদারি প্রতিষ্ঠান হেলাল ট্রেডার্সের মালিক হেলাল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, শুরুর দিকে দামটা ভালোই ছিল। এখন কমছে। ফলে কৃষকও ধান বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। আমরাও কেনা ধানগুলো শহরের মোকামে বিক্রি করতে পারছি না।

যদিও সরকার বলছে, কৃষকের স্বার্থেই এবছর সরকার বেশি দামে ধান কিনছে। গত রোববার সচিবালয়ে নিজ অফিসকক্ষে বোরো সংগ্রহ অভিযান-২০২৩ এর ভার্চুয়াল উদ্বোধন শেষে সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী একথা বলেন। তিনি বলেন, কৃষক তার ফসলের ভালো দাম পাক। কৃষক ভালো দাম পেলেই আমরা খুশি। আর সেটা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।

সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকার এবার বেশি দামে ধান কিনছে। কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনা করেই এটা করা হয়েছে। কৃষকরা ধান দিতে এসে যেন কষ্ট না পায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, কৃষক ধানের দাম কিছুটা কম পেলেও এবছর সারাদেশে ব্যাপক ফলন হয়েছে। তাতে তাদের অনেকটা পোষাচ্ছে। তারপরও ধানের যে দাম সেটা দিয়ে খরচ উঠছে না এমনটা নয়। তবে দাম আরও বেশি হলে কৃষকরা চাষে বেশি আগ্রহী হতো।

ধানের ফলন ও সরবরাহ বেশি থাকায় ধানের দাম কম বলে মনে করেন নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোধ বরণ সাহা চন্দন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ধানের দাম গত বছরের চেয়ে কম। কারণ এবছর ফলন অনেক বেশি। বিঘাপ্রতি প্রায় আড়াই-তিন মণ ধান বেশি হয়েছে এবছর। এছাড়া বাজারে ধানের ব্যাপক সরবরাহ রয়েছে। সেজন্য দাম কিছুটা কমে গেছে।

চলতি বোরো মৌসুমে সরকার চার লাখ টন বোরো ধান সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কৃষক ধানের সঠিক দাম না পেলে সরকার প্রয়োজনে সাত-আট লাখ টন ধান কিনবে। আর চাল কেনা হবে সাড়ে ১২ লাখ টন। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের সভাকক্ষে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় বোরো ধান, চাল ও গমের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ টাকা। এছাড়া সিদ্ধ চাল ৪৪ টাকা দরে কেনা হবে। ২০২২ সালে ধান ২৭ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪০ টাকা এবং গম ২৮ টাকায় সংগ্রহ করা হয়েছিল।

বোরো সংগ্রহ অভিযান ভার্চুয়াল উদ্বোধন হলেও এখনো কোনো এলাকায় ধান কেনা শুরু হয়নি। যে কারণে বাজারে ধানের দাম নিম্নমুখী থাকছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক কৃষক।

দাম কমলে চালকলের মালিকেরা আগেই ধান কিনে মজুত করে রাখেন। এ কারণে চালের দাম বাড়লেও কৃষক তার ভাগ পান না। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি হলেও ভোক্তাদের গুনতে হয় চড়া দাম। একদিকে এতে কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অন্যদিকে বাজারে গিয়ে দামের কারণে নাভিশ্বাস উঠছে ক্রেতার।