দেশে তালাকের সঙ্গে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

অভিমানে, কষ্টে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় জয়শ্রী জামানের দুই সন্তান, ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থী ১৮ বছর বয়সী চিরশ্রী জামান ওরফে মুনমুন এবং ১৫ বছরের মোহাম্মদ বিন আলীম। এ ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা দেশ। জয়শ্রী ও আলীমুলের বিবাহ বিচ্ছেদে তাদের দুই সন্তানের একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাটি, বাবা-মায়ের বন্ধন অটুট না থাকলে যে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, সেই নির্মমতার বহিঃপ্রকাশ বটে।

গত বছর ৩০ ডিসেম্বরের ঘটনা। রাজধানীর গুলশানের নিকেতনে স্বামীর কাছ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের চিঠি পেয়ে রাগে-ক্ষোভে কাচের বোতল ভেঙে পেটে ঢুকিয়ে মাহিমা খানাম মুলান নামে ২৩ বছর বয়সী এক নারী আত্মহত্যা করেন।

মুলানের স্বামী জুবায়ের হোসেন জানান, ২০২২ সালের ২ মে তাদের বিয়ে হয়। প্রথম দুই থেকে তিন মাস ভালোই চলছিল তাদের সংসার। তবে মুলান খারাপ ব্যবহার করতে থাকলে ২৬ ডিসেম্বর তাকে তালাক দেন জুবায়ের। এরপর থেকে তিনি বাড়ির বাইরে থাকতেন। ৩০ ডিসেম্বর নিকেতনে তার অফিসে এসে মুলান ঝগড়া শুরু করেন। একপর্যায়ে ফ্রিজ থেকে বের করে কাচের বোতল ভেঙে নিজের পেটে ঢুকিয়ে দেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মুলানকে মৃত ঘোষণা করেন।

দুই শিক্ষার্থী চিরশ্রী ও আলীম কিংবা গৃহবধূ মুলানই শুধু নয় দেশে এমন আত্মহত্যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে একদিকে, যেমন বেড়েছে তালাকের সংখ্যা অন্যদিকে, বেড়েছে আত্মহত্যার সংখ্যাও। মা-বাবার তালাকের কারণে সন্তান প্রায় সময় হতাশাগ্রস্ত থাকে। অনেক সময় স্কুল-কলেজে মা-বাবার ডিভোর্সের জন্য বন্ধুরা হাস্যকরভাবে টিজ করে। একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে নিতে প্রস্তুত নয় এমন আচরণ। যে কারণে শিশু-কিশোরদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বিয়ে, পরিবার, সন্তানপালন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ, দায়-দায়িত্ব, টাকা-পয়সার ভাগ-বাটোয়ারা, বিয়ের পর অন্য নারীতে বা পুরুষে আসক্ত হওয়া বিষয়গুলো দিন দিন বাড়ছে। এসব জটিলতাকে কেন্দ্র করে বাড়ছে অসুখী দাম্পত্য জীবন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আরও তিক্ত হচ্ছে, কিন্তু এরপরও অনেকে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বা সামাজিক সমালোচনা এড়াতে অসুখী সম্পর্ক টিকিয়ে রাখেন। এভাবে চলতে চলতে একদিন এমন একটা দুঃসহ পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, যখন আর পালিয়েও বাঁচা যায় না। সে পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে স্বামী বা স্ত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আবার অনেক সময় দেখা যায়, মা-বাবার অসুখী সম্পর্কের জেরে সন্তান আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে মা কিংবা বাবা সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেন অথবা মা-সন্তান একসঙ্গে আত্মহত্যা করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, তালাক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা ও প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যাহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় এবং মাদক এসবের কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

ঠিক এরকম একটা পটভূমিতেই দেশে তালাকের হার বাড়ছে। তালাকের এই সংখ্যা বৃদ্ধির হার রীতিমতো ভয়াবহ। ঢাকায় ৪০ মিনিটে ১টি করে তালাক হচ্ছে। গত বছর রাজধানীতে তালাক হয়েছে প্রতিদিন ৩৭টি করে। সারাদেশেই বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে। তালাকের হার পল্লি অঞ্চলে শহরের তুলনায় প্রায় ৮০ শতাংশ বেশি। শহরের ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারের দম্পতিরা বিভিন্ন কারণে যে বিষাক্ত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, গ্রামের মানুষ সেটা করছেন না।

ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে তালাকের আবেদন জমা পড়ে মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৬৯৮টি এবং উত্তর সিটিতে ৫ হাজার ৫৯০টি। এ হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক, অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে ১টি করে।

আত্মহত্যার এই প্রবণতা সমাজের নানা স্তরের মানুষের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, দেশে বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার এই প্রবণতা বাড়ছে। আর দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর এ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বিশ্বে সার্বিকভাবে মৃত্যুর ১৭তম প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা। যেখানে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ আত্মহত্যা। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ ৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এ হিসাবে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

যদিও দারিদ্র্য সরাসরি আত্মহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তবে এটি আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর যত মানুষ আত্মহত্যা করে তার ৭৭ শতাংশই হয়ে থাকে কম আয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ২০২১ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসা সেবাগ্রহণকারী নারীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। সম্প্রতি তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে সংস্থাটি জানায়, ১৭৭ জন নারী আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীর মধ্যে ১২২ জনই মাদকাসক্ত ছিল। তাদের মধ্যে ১৬৩ জনের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে এবং ৭৪ জন আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কমপক্ষে একটি মানসিক রোগ ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের তুলনায় অ্যালকোহল ব্যবহারকারীরা ১০ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে এবং যারা শিরায় নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে তারা ১৪ গুণ বেশি আত্নহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে দেশের মাদক ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন হয়েছে এবং ইয়াবার সহজলভ্যতার কারণে এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইয়াবা উত্তেজক মাদক হিসেবে পরিচিত যা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা বেশি ব্যবহার করছে।

দীর্ঘদিন ধরে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় কাজ করে আসছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। তারা জানিয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ৩৬১ জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সংস্থাটির সমীক্ষার তথ্য বলছে, গত আট মাসে গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ৪৫ দশমিক ১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। যেখানে স্কুলের শিক্ষার্থী ১৬৯ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ৯৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৬৬ জন এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী রয়েছে ৩০ জন। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ছেলে শিক্ষার্থী ১৪৭ জন, আর মেয়ে শিক্ষার্থী ২১৪ জন।

# আত্মহত্যার শীর্ষে ঢাকা

চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়াও খুলনা বিভাগে ১৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ, রংপুরে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১০ শতাংশ, রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ, বরিশালে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং সিলেটে আত্মহত্যা করেছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

# মেয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার বেশি

আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সংখ্যায় মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি। ৩৬১ জনের মধ্যে গত আট মাসে আত্মহত্যা করেছে ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। বাকি ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

শুধু মেয়ে শিক্ষার্থীদের বেশি আত্মহত্যার কারণ খতিয়ে দেখা যায়, ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী অভিমানে, প্রেমঘটিত কারণে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, ৫ দশমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির কারণে এবং পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতার কারণে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে।

# আত্মহত্যায় স্কুলগামী শিক্ষার্থী বেশি

আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তর বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশই স্কুলগামী। তাদের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল ১১২ জন এবং ছেলে শিক্ষার্থী ছিল ৫৭ জন। এছাড়া আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে কলেজগামী শিক্ষার্থী ছিল ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ছিল ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদরাসার শিক্ষার্থী ৮ দশমিক ৩১ শতাংশ।

# ৮ মাসে ৩০ মাদরাসা শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

৩৬১ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩০ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছে। তাদের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থী ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ছেলে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার হার ছিল ৪৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশের আত্মহত্যার পেছনে অন্যতম কারণ অভিমান। আর প্রেমঘটিত সম্পর্কের জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশের আত্মহত্যার পেছনে দায়ী যৌন নির্যাতন।

বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:

• শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন
• শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা
• পারিবারিক কলহ এবং সম্পর্কের বিচ্ছেদ
• মাদকের অপব্যবহার
• অর্থনৈতিক সমস্যা
• পড়াশোনার চাপ
• বেকারত্ব
• পারিবারিক আত্মহত্যার ইতিহাস

আত্মহত্যার ঝুঁকির লক্ষণগুলো হলো:

>মৌখিক হুমকি
>ঘন ঘন মৃত্যু সংক্রান্ত ইচ্ছার কথা বলা
>যখন দেখছেন আপনার সন্তান বা কাছের মানুষটি হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে
>তার চেহারা, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে উদাসীন বা ওজন খুব দ্রুত বাড়ছে বা কমছে
>ফেসবুক বা সোশাল মিডিয়াতে মৃত্যু নিয়ে বেশি পোস্ট বা ঘটনা দিচ্ছে
>শরীরে অপ্রত্যাশিত আঘাতের চিহ্ন
>যখন বলে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে, তোমরা আমাকে কেউ ভালোবাসো না বা আমি চলে গেলে তোমাদের কিছু যায় আসে না।
>শোক

# আত্মহত্যা প্রতিরোধে একজন অভিভাবকের করণীয় কী হতে পারে:

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবক হিসেবে আমাদের প্রথম করণীয় হলো আত্মহত্যা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। আমাদের কাছের মানুষগুলোর ছোট ছোট পরিবর্তনগুলোকে লক্ষ্য করা, তাদের প্রতি সমব্যথী হওয়া, সহমর্মী হওয়া, তাদের যে তীব্র কষ্ট হচ্ছে সেই কষ্ট থেকে তাদেরকে বেরিয়ে আসতে মানসিক এবং সার্বিক সহায়তা করা। তারা যে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং ভালোবাসার মানুষ এই বার্তাটা তাদেরকে পৌঁছানো। তাদের জীবনের প্রতি আশা জাগাতে সাহায্য করা।

সমাজের একজন সদস্য, একজন তরুণ, একজন পিতা-মাতা, একজন বন্ধু, একজন সহকর্মী বা একজন ব্যক্তি হিসেবে যারা আত্মহত্যার সংকটে পড়েছে বা যারা আত্মহত্যার কারণে শোকাহত তাদের এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সহযোগিতা করতে হবে। আমরা সবাইকে সমস্যাটি সম্পর্কে বোঝার জন্য উৎসাহিত করতে পারি, যারা সংগ্রাম করছেন তাদের কাছে পৌঁছাতে এবং আমাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। আমরা সবাই কাজের মাধ্যমে আশা তৈরি করতে পারি এবং মানুষকে আলো দেখাতে পারি।

# আত্মহত্যার প্রবণতা রোধের উপায়:

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে খুব বেশি শক্তিশালী নয়। মা-বাবা, শিক্ষকদের শাসন অথবা সামাজিক যেসব বৈষম্য রয়েছে তারা সেগুলো খুব সহজে নিতে পারে না। ফলে অনেকেই আত্মহত্যার চেষ্টা করে। প্রতিনিয়ত আমাদের সন্তানদের কাছে যে প্রত্যাশা এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেতে হবে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে। সামাজিক এসব প্রত্যাশা পূরণ না হলেও অনেক সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে কেউ কেউ। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সমস্যার কথা শেয়ার করার কোনো প্ল্যাটফর্ম পায় না। কোনো বন্ধুকে আত্মহত্যার কথা বললে সে বন্ধুটিও আত্মহত্যার বিভিন্ন উপায় নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে বের করে দেয়।

আত্মহত্যা রোধের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের পারিবারিক বন্ধন বাড়ানো প্রয়োজন। স্কুল-কলেজে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ থাকা প্রয়োজন। যার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা খোলামেলা সবকিছু বলতে পারবে, শেয়ার করতে পারবে। আমাদের দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অপ্রতুল সে ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে একজন কাউন্সেলর নিয়োগ করা যেতে পারে। যে মূলত শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার বাইরে অন্য সমস্যাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনবে এবং সমাধানের পথ দেখাবে। অন্তত তিন মাস অন্তর মানসিক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করালে সমাধানের আওতায় আনা যাবে বলে আশা করছি।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের সিনিয়র সাইক্লোজিস্ট রাখী গাঙ্গুলী বলেন, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসা সেবাগ্রহণকারী নারীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩২২ জন সেবাগ্রহণকারী নারীর মধ্যে ১৭৭ জনের আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। এর মধ্যে ৯৮ জন কখনো না কখনো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং ৫ জন চিকিৎসা নেওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনের পরিসমাপ্তি টেনেছে।

তিনি বলেন, নারী মাদকাসক্তরা পুরুষ মাদকাসক্তদের তুলনায় মানসিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে তারা আত্মহত্যার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকে। ঝুঁকিপ্রবণ জনগোষ্ঠী হিসেবে মাদকগ্রহণকারীরা আত্মহত্যা প্রবণতার উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছে। এর কারণ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত মাদকগ্রহণ সংশ্লিষ্ট সংকট, বিষণ্নতা, অতিমাত্রায় মাদকগ্রহণের কারণে সিদ্ধান্তহীনতা বা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা, চিকিৎসার পরেও মাদকমুক্ত থাকতে ব্যর্থ হওয়া, পরিবারের অসহযোগিতা ও সন্দেহ এবং মাদকাসক্তির কারণে অন্যান্য মানসিক সমস্যা।

ব্রাইটার টুমরো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জয়শ্রী জামান বলেন, ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইংলিশ মিডিয়ামের দুই শিক্ষার্থী যারা আপন দুই ভাইবোন তারা একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছিল। সেই বাচ্চা দুটো ছিল তার। এ ধরনের ঘটনার পরে একটা বছর তিনি চিন্তা করলেন আত্মহত্যা প্রতিরোধে কী করা যায়। আর কেউ যাতে এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনার শিকার না হয় এ জন্য আত্মহত্যা প্রতিরোধে ‘ব্রাইটার টুমরো ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন তিনি। যে প্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা হয়।

তালাকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি পরিবারে মা-বাবা সবাইকে সচেতন থাকা জরুরি। কারণ তাদের আচার-আচরণ সন্তানদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। আত্মহত্যা থেকে ফেরানোর জন্য সম্মিলিত চেষ্টা প্রয়োজন। তাই আমি সবার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলি। মিটিং করি, লেখালেখি করছি। তিনি আরও বলেন, সুইসাইড প্রিভেনশনের দুইটা মেথড রয়েছে, একটা হলো কাউন্সেলিং অন্যটি মেডিকেশন। এ দুই পদ্ধতিতে মানুষকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাদের সঠিক চিকিৎসা দিতে হবে এবং কাউন্সেলিং করাতে হবে। তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। ভালো আচরণ দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের চেয়ারপারসন শান্তা তাওহিদা বলেন, নিজেকে নির্মমভাবে হত্যার অপর নাম আত্মহত্যা। এই নির্মমতার প্রভাব অবর্ণনীয়। প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময় আফসোস করে আমাদের জীবন কেন এত ক্ষণস্থায়ী? এত সুন্দর পৃথিবী, এত সুন্দর জীবন আর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কের এত মধুর বন্ধন ছেড়ে কে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চায়? এ প্রশ্নের উত্তর, ‘না’। আত্মহত্যা যে কত নির্মম, আত্মহত্যা যে কত নিষ্ঠুর-তা কেবল প্রিয়জন হারা মানুষগুলো বুঝতে পারে। মৃত্যুর ওপারের জীবন কেমন আমাদের জানার সুযোগ নেই। তাই হয়তো বেঁচে থাকার এপারের জীবনে মানুষ এমন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয় যে ঘটনায় তার জীবন হয়ে ওঠে অতি তুচ্ছ যা হননে একজন মানুষ জীবনের মহত্ত্ব একটি মুহূর্তের জন্য ভুলে যায়। এই নিষ্ঠুর ঘটনা হতে পারে একটি ঘটনা অথবা কয়েকটি ঘটনার সমন্বয় যা রূপ নেয় ভয়ংকর বিষণ্নতায় মোড়া এক অলীক পরিণতির।

তিনি বলেন, আমাদের বাচ্চাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে সচেতনতা এখনো আমাদের সমাজে গড়ে ওঠেনি। হতাশা থেকে মানসিক নানা ধরনের যে রোগ হতে পারে সেখানে অনেকেই উদাসীন। দেশের একটি জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ। তারুণ্যের শক্তি আমরা তখনই কাজে লাগাতে পারবো যখন তাদের শিক্ষা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ করা যাবে। গত কয়েক মাসে যত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে তাদের মধ্যে বেকারত্ব কিংবা বিষয় সংশ্লিষ্ট চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়াদের অনেকাংশে রয়েছে।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর পরিদর্শক (ফোকাল পার্সন অ্যান্ড মিডিয়া) আনোয়ার সাত্তার বলেন, ৯৯৯ সারাদেশে প্রায় দুই হাজার আত্মহত্যা ঠেকিয়েছে। একই সময়ে ফোনে সাড়া দিয়ে এক হাজারের বেশি মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাদের সবাই আত্মহত্যা করেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে অনেক সময় আত্মহত্যা চেষ্টার তথ্য জানিয়ে কল আসে। অনেক সময় ভিকটিম নিজেই কল দিয়ে আমাদের কাছে জানান যে, তিনি পারিবারিক কিংবা কোনো কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে আমরা কৌশলে তার অবস্থান জেনে তার সঙ্গে কথা বলে উদ্ধার করার চেষ্টা করে থাকি। এছাড়া অনেক সময় প্রতিবেশি কিংবা ভিকটিমের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কল দিয়ে ৯৯৯-এ জানায়।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. আহসান আজিজ সরকার বলেন, বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া অথবা ডিভোর্স থাকার কারণে বয়ঃসন্ধিকালে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ হচ্ছে পরিবারে খুব বেশি কনফ্লিকট থাকে। বয়ঃসন্ধি ছেলে-মেয়েদের যেকোনো চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা কম। বড়দের চাইতে তারা ইমোশন কম কন্ট্রোল করতে পারে। তারা স্বাধীনতা চায়। এই স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যাঘাত ঘটে তখন তারা আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।

তালাক হওয়ার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আত্মহত্যা কোনো নির্দিষ্ট কারণে হতে পারে না। আত্মহত্যার কিছু ঝুঁকি থাকে। জৈবিক কারণ থাকতে পারে। এরমধ্যে প্রচণ্ড ইমোশনাল, তাড়াহুড়ো করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া জৈবিক কারণের মধ্যে পড়ে। কিছু ঝুঁকি আছে সামাজিক ঝুঁকি। এরমধ্যে বেকারত্ব একটি। সমাজে আত্মহত্যার দিকটি পজিটিভভাবে প্রচার করা হচ্ছে বলেও অনেকে মনে করে। আত্মহত্যা যারা করে তারা অনেক সাহসী কিংবা প্রেমে ব্যর্থ হলে আত্মহত্যা। সমাজ কীভাবে আত্মহত্যাটা প্রচার করছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছু থাকে সাইকোলজিক্যাল। কারণ যারা আত্মহত্যা করতে যায় তারা ৯৯ শতাংশ হতাশাগ্রস্ত-বিষণ্ণতায় ভোগে। যার ক্ষেত্রে যতবেশি ঝুঁকি জমা হতে থাকে তার আত্মহত্যার প্রবণতা তত বাড়তে থাকে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে আত্মহত্যার সংখ্যাটি কাছাকাছি। অভিমান কিন্তু অনেকেই করে, সবাই কিন্তু আত্মহত্যা করে না। শিক্ষার্থীরা যে আত্মহত্যা করছে সেটার জন্য আমাদের উচিত তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মনোযোগী হওয়া। তার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের এবং শিক্ষকদের নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দায়িত্বশীল হতে হবে যেন তারা তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত্নবান হতে পারেন। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। কেউ একা থাকছে, খাবার টেবিলে খেতে আসছে না, কেউ রাত জাগছে এ ধরনের ক্ষেত্রে সন্তানকে গুনগত সময় দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ডিস্ট্র্যাকটেড প্যারেন্টিং যেন না করি। নিজেকে ভালো না রাখতে পারলে, সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা সম্ভব না।