দেশের অর্থনীতির উদ্বেগজনক তথ্য: সত্যাসত্য জানতে চায় জনগণ

গোলাম সারওয়ার। ফাইল ছবি

গোলাম সারওয়ার: 

১২মে ‘প্রথম আলোয়’ দেশের অর্থনীতি বিষয়ক কয়েকটি ভয়ঙ্কর এবং উদ্বেগজনক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছ।যা পড়ে প্রতিটি সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিকের মন খারাপ হয়ে যাবে।সাধারণ জনগণ গণমাধ্যমেই সব খবরা খবর জানতে পারে এবং বিশ্বাস রাখতে চায় ।কোন্ তথ্য সত্য আর কোন্ তথ্য অসত্য-তা যাচাই করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই।এইসব সংবাদের সত্যাসত্য জানার অধিকার জনগণের আছে।তাই আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই,দেশের অর্থনীতিতে এইসব অশনিসংকেত কী কারণে হচ্ছে,গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে কি না, তার প্রকৃত চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জানতে পারি,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘প্রথম আলো’ এবং ‘ডেইলি স্টার’ পড়েন না।এই দুই পত্রিকা নাকি তাঁকে খোঁচা দিয়ে লেখে।দীর্ঘ বিশ বছর ধরে তারা তাঁর বিরুদ্ধে নানা খবর প্রচার করে আসছে।তাদের কাজ নাকি অন্ধকারে’।তাই আমাদের সন্দেহ জাগাটা অস্বাভাবিক নয় যে,দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি এই দুটি পত্রিকা সম্পর্কে এ ধরনের নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন,তবে আমরা কী ছার।প্রশ্ন জাগে,তারপরেও দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে,কেন এই পত্রিকা দু’টির বিরুদ্ধে তিনি কোন আইনগত ব্যবস্থা নেননা!এতদসত্বেও এখন পর্যন্ত “প্রথম আলো” কী কারণে পাঠকনন্দিত এবং প্রচার সংখ্যায় সর্বশীর্ষে-সেটা গবেষণার দাবি রাখে।

বৃহস্পতিবারের ‘প্রথম আলোর’ প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনাম করেছে “টাকা আরো দুর্বল হচ্ছে”। মূলত: বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটা ভাল আছে,তারই উপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন করা হয়েছে।প্রতিবেদনে গত বছর এবং চলতি অর্থবছরের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির এক চিত্রে দেখানো হয়েছে,আমদানি ব্যয় লাগামহীনের ক্ষেত্রে গত অর্থবছরে ছিল ১৯.৭৩%,এবার প্রবৃদ্ধি ৪৬.৬৮%।বাণিজ্য ঘাটতি গতবার ছিল ১,২৩৬ কোটি ডলার,এবার বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২,২৩০ কোটি ডলার।প্রবাসী আয় কমতেই আছে।গত অর্থবছরে ছিল ৩৬.১০% আর এবার কমে হয়েছে (-)১৬.২%।চলতি আয়ে এবার রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি হয়েছে,১,৪০৭ কোটি ডলার-যা গত বছর ছিল ৫৫ কোটি ডলার।এই তথ্য অবশ্যই উদ্বেগের।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রথম আলো বলেছে,”আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের জোগান দিতে গিয়ে মাত্র ৫ মাসের আমদানি বিল পরিশোধের রিজার্ভ আছে।পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকলে বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠবে”। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে,’রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি। এজন্য ডলারের দাম বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সারা দেশে’।ফলশ্রুতিতে রিজার্ভে টান পড়ছে,ডলারের দর বৃদ্ধি পাচ্ছে,টাকার মূল্যমান কমছে।এর জের ধরে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে,মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে’।ইতোমধ্যে বাজারে তার প্রভাব পড়তেও শুরু করেছে।প্রথম আলোর খবরে বলা হচ্ছে,বাস্তবতার নিরিখে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তন্মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর স্থগিতসহ কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন বন্ধ করেছে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে লাগাম টেনেছে।এই খবরতো দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।

প্রথম পাতায় আরেকটি খবরের শিরোনাম হলো “আন্তর্জাতিক লেনদেন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিপদ বাড়ছে”।এই খবরের মূল বক্তব্য হলো,দেশের অর্থনীতিতে যে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে তার ফলে চলতি আয়ের ভারসাম্যে যে ঘাটতি,তা দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেন নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার।পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকেও এখন ভাবতে হচ্ছে। এই তথ্যও উৎকন্ঠা জাগায়।

এই পত্রিকার প্রথম পাতার আরেকটি শিরোনাম হলো,”যুক্তরাষ্ট্রের ডিএফসি তহবিলের সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ “।ডিএফসি হলো যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা।খবরে বলা হয়েছে, মংগলবার USAID- এর উপ প্রশাসক ইসোবেল কোলম্যান শ্রম অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন,জিএসপি স্থগিত থাকায় ডিএফসি’র অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রসঙ্গত কোনো দেশে ডিএফসি’র অর্থায়নের ক্ষেত্রে সে দেশের পরিবেশ,মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের উচ্চমান নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না,তা তারা বিবেচনায় নেয়।এ প্রসঙ্গে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও’র উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকা বলেছে, “বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নের জন্য আদর্শ উৎস হতে পারে ডিএফসি।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়টি হচ্ছে,জিএসপি ফিরে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত ডিএফসি’র অর্থায়নের জন্য বিবেচিত হবেনা বাংলাদেশ”। এই খবরটিও উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো।

ঐ তারিখের প্রথম আলোর ৩ এর পাতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি কেনা নিয়ে “৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতির” আরেকটি বিশেষ প্রতিবেদন রয়েছে।টিআইবির এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বরিশালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের বাঁশখালি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়ির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে ৩৯০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। পত্রিকান্তরে টিঅাইবি বলেছে,বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সুশাসনের ঘাটতি প্রকট।প্রয়োজন না থাকলেও প্রভাবশালী মহলকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার।টিঅাইবি আরো বলেছে,”বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দাতাদের কাছে বাংলাদেশ জিম্মি হয়ে গেছে।অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না”।এখানেও বিষয়টি উদ্বেগের।

প্রথম আলোয় দেশের অর্থনীতি বিষয়ক শুধুমাত্র ‘একটি দিনের’ প্রকাশিত সংবাদ আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এইভাবে পত্রিকাটি দিনের পর দিন নানা বিষয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণামূলক সংবাদ প্রকাশ করে চলেছে।এমনকি সম্পাদকীয় এবং উপ সম্পাদকীয়তে যে ধারালো এবং বলিষ্ঠভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়-যা সকলকে ভাবিয়ে তুলছে, উৎকন্ঠিত করছে। জনগণ বুঝতে পারছে না,প্রথম আলোর এই ভূমিকায় ‘জনগণ’ বিভ্রান্ত হচ্ছে, না ‘সরকার’ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে।সাংবাদিকতার রীতিনীতি কতটা মানছে প্রথম আলো – সে সম্পর্কে জনগণ পরিষ্কার ধারণা পেতে চায়।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক সুজিত রায় তাঁর ‘সংবাদ সাংবাদিক সাংবাদিকতা’ বইয়ে বলেছেন, “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদ মাধ্যমগুলিই প্রকৃত বিচারকের মানদন্ড হাতে তুলে নেয়।সবরকম সামাজিক,প্রশাসনিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক অন্যায় ও অবিচারের প্রতি দৃষ্টিপাত এবং তার মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলে শাসনযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এক অমোঘ অস্ত্র এই সংবাদ মাধ্যম।বাক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায়,সাংবিধানিক নিয়ম-নীতি সমন্বিত মৌলিক বিষয়গুলি সঠিকভাবে রূপায়িত করার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা এই সংবাদ মাধ্যমগুলির প্রধান কাজ।পাশাপাশি সমাজের যা কিছু ভাল,সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে সে গুলিকেও তুলে ধরা সাংবাদিকতার অন্যতম শর্ত”।
বোদ্ধাজনরা বলেন,সাংবাদিকতা সমাজের দর্পণ।কিন্তু আদর্শ এবং নীতিবর্জিত সাংবাদিকতা কখনই সমাজের দর্পণ হতে পারে না।তবে সমাজ যদি নীতি বহির্ভূতভাবে চলে,তার ছাপতো সাংবাদিকতা নামক দর্পণে পড়তে বাধ্য।পর্যবেক্ষণকারিদের কাছে সকলের একটাই জিজ্ঞাস্য, প্রথম আলো রীতিনীতির বাইরে চলছে,না সমাজটাই নীতিবহির্ভূতভাবে চলছে?

পবিত্র সংবিধান আমাদের চিন্তার,বিবেকের এবং বলার স্বাধীনতা দিয়েছে।সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতারও নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে সংবিধানে।কিন্তু স্বাধীনতার নামে যারা বিভ্রান্তিকর এবং হলুদ সাংবাদিকতা করার মাধ্যমে সমাজে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা,অস্থিরতা ছড়াচ্ছে-সেটা কখনও কাম্য নয়,বিবেচ্য নয়।সেক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতেই হয়, অন্ধকার জগতের কাজ দিয়ে নয়,আমরা আলোর জগতের মানুষের কর্মযজ্ঞ দ্বারা আলোকিত সমাজ দেখতে চাই।

গোলাম সারওয়ার
ডেপুটি রেজিস্ট্রার (অব.)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।