গুটিজাতের লিচুতেই বাজার দখল

রাজশাহীর লিচুতে এবার ৪৪ কোটি টাকার ব্যবসার সম্ভাবনা

আমজাদ হোসেন শিমুল :

রাজশাহীতে আমের পাশাপাশি সুস্বাদু ফল লিচুর চাষ ও উৎপাদন বাড়ছে। চলতি মৌসুমে ৫১৯ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। বর্তমানে রাজশাহীর বাজার গুটিজাতের লিচুর দখলে রয়েছে। তবে বোম্বাই লিচু নামতে আরও প্রায় সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। রাজশাহীতে এবার ৩ হাজার ১৪৪.১০ মেট্রিকটন (হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৬ মেট্রিকটন) লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গড়ে প্রতি কেজিতে ৪০টি লিচু ধরে হিসাব অনুযায়ী ১০০ টি লিচুর ওজন আড়াই কেজি হয়। আর ১০০ লিচুর গড় মূল্য ধরা হয়েছে ৩৫০ টাকা। সেই হিসাবে চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে ৪৪ কোটি ১ লাখ ৭৪ টাকার লিচুর ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে- গত বছরের তুলনায় রাজশাহীতে এবার লিচুর উৎপাদন কিছুটা বেশি। ফলনও গত বছরের চেয়ে অনেকটা ভালো। কেননা গত বছর গাছে লিচু কম ধরেছিল। তাই এ বছর প্রাকৃতিকভাবেই লিচু ধরেছে অনেকটা বেশি। আর গত বছর লিচুর ফুল থেকে গুটি আসা পর্যন্ত নানা বৈরী আবহাওয়া থাকায় ফলন কিছুটা কম হয়েছে। তবে গত বছর জেলায় ৫১৯ হেক্টর জমিতে ৩০৩৬.১২ মেট্রিকটন ( হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৫.৮৫০ মেট্রিকটন) লিচুর উৎপাদন হয়েছিল। আর গত বছর লিচুতে বিকিকিনি হয়েছে ৪২ কোটি ৫০ লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ টাকার।

ফল গবেষকরা বলছেন, লিচুর ফুলের পরাগায়নের সময় তাপমাত্রা কম থাকা প্রয়োজন। কিন্তু গত বছর শীতের শেষে হঠাৎ গরম পড়ে যায়। এর কিছুদিন পর গত বছর হঠাৎ একটানা কয়েকদিন ভোরে কুয়াশা পড়েছে। ফলে পরাগায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কিছুদিন পর চলে খরা। এতে গুটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। তবে এবার লিচুর অন সিজিন হওয়ায় গাছে লিচুর ফুল বেশি এসেছিল। এজন্য গত বছরের তুলনায় এবার উৎপাদন কিছুটা বাড়বে।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন বলেন, লিচুর ভালো পরাগায়নের জন্য ১২০ ঘণ্টা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও কম তাপমাত্রা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এবারও কিন্তু হঠাৎ করেই শীতের পর তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিচুর জন্য চলতি মৌসুম অন সিজিন হলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে লিচুর পরাগায়নে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উৎপাদন আশানুরূপ হবে বলে মনে হয় না। তারপরও গত বছরের চেয়ে ফলন এবার অনেকটা ভালো।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার ৯টি উপজেলা ও মহানগরীর ২টি থানা এলাকায় কমবেশি লিচু চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি লিচুর চাষ হয় জেলার বাগমারা উপজেলায়। চলতি মৌসুমে বাগমরায় ১১৫ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। এই উপজেলা থেকেই ৬৯০.২০ মেট্রিকটন (হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৬ মেট্রিকটন) লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এছাড়া জেলার পবায় ৭৫ হেক্টর জমিতে ৪৫৫ মেট্রিকটন (গড় ফলন ৬.০৭ মেট্রিকটন), দুর্গাপুরে ৭০ হেক্টর জমিতে ৪২১ মেট্রিকটন (হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৬.০১ মেট্রিকটন), পুঠিয়ায় ৬৬ হেক্টর জমিতে ৩৯৩ মেট্রিকটন (গড় ফলন ৫.৯৫ মেট্রিকটন), মোহনপুরে ৫২ হেক্টর জমিতে ৩১০ মেট্রিকটন (গড় ফলন ৫.৯৬ মেট্রিকটন), চারঘাটে ৪৫ হেক্টর জমিতে ২৭২ মেট্রিকটন (গড় ফলন ৬.০৪ মেট্রিকটন), তানোরে ৩০ হেক্টর জমিতে ১৭৬ মেট্রিকটন (গড় ফলন ৫.৮৮ মেট্রিকটন), বাঘায় ২১ হেক্টর জমিতে ১২৬.৪০ মেট্রিকটন (গড় ফলন ৬.০২ মেট্রিকটন), মহানগরীর মতিহারে ২১ হেক্টর জমিতে ১২৫ মেট্রিকটন (গড় ফলন ৫.৯৫ মেট্রিকটন) এবং বোয়ালিয়া থানা এলাকায় ১০ হেক্টর জমিতে ৫৯ মেট্রিকটন (গড় ফলন ৫.৯০ মেট্রিকটন) লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আজ শুক্রবার (১৩ মে) রাজশাহী মহানগরীর ছোটবনগ্রাম, রায়পাড়া, পুঠিয়ার ঝলমোলিয়াসহ কয়েকটি এলাকার বাগান ঘুরে দেখা গেছে, লিচুগাছে লিচু পেকে গোলাপী রং ধারণ করেছে। যেন লিচুর পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে টাকা। লিচু চাষিরা জানিয়েছেন, রাজশাহী অঞ্চলে মূলত উন্নতমানের জাত হিসাবে বোম্বাই, মাদ্রাজি, কাদমি, মোজাফফরপুরী, বেদানা, কালীবাড়ি, মঙ্গলবাড়ি, চায়না-৩, বারি-১, বারি-২ ও বারি-৩ জাতের লিচু উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে বোম্বাই লিচুর আকর্ষণ বেশি। সবচেয়ে বেশি গাছ রয়েছে বোম্বাই লিচুরই। এবার এবারও লিচুর জন্য আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় এই জাতের লিচুর কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।

মহানগরীর রায়পাড়া এলাকার লিচুচাষি আবদুল গাফ্ফার বলেন, এবার গাছে ফুল এসেছিল বেশি। তবে সেই ফুল থেকে ঠিকমতো গুটি হয়নি। কারণ যখল ফুল থেকে পরাগায়ন হয় তখন লিচুর জন্য অনুকূল পরিবেশ না থাকায় ফলন কিছুটা হলেও কম হবে। তবে গত বছর যেমন ইজারা নেওয়া বাগানে ক্ষতি হয়েছে এবার সেই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।

রাজশাহীর পবা উপজেলার কসবা গ্রামের লিচুচাষি আরিফুল ইসলাম জানান, তার বাগানেরও অবস্থা এবার অনেকটা ভালো। গাছে পাতার ফাঁকে ফাঁকে বোম্বাই লিচু দেখে মনে ভরে উঠছে। কয়েকদিনের মধ্যেই লিচুগুলো নামানো যাবে। বাগানে যে পরিমাণ লিচু আছে তাতে হয়তো এবার গতবছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে জানান তিনি।

এদিকে রাজশাহীর লিচুর বাজার এখন গুটিজাতে ছোট ছোট লিচুর দখলে। মৌসুমের শুরুতেই দেশি গুটিজাতের লিচু অনেকটা না পাকতেই বাজারে এনে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে লিচুর যে সুমিষ্ট স্বাদ সেটি ক্রেতারা পাচ্ছেন না। নগরীর সাহেব বাজারে লিচু কিনতে আসা নগরীর টিকাপাড়া এলাকার রায়হান বলেন, ‘১০০ লিচুর দাম ৩২০ টাকা। তবে লিচুর পরিপক্বতা আসেনি। মৌসুমের শুরু এজন্য নিলাম।’ মনিচত্ত্বর এলাকার লিচু ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন বলেন, ‘এখন শহরের মধ্যেই দেশি জাতের লিচুগুলো ভেঙ্গে বাজারে বিক্রি করছি। লিচুজাতের লিচু খুব বেশি সুমিষ্ট হয় না। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই বাজারে বোম্বাই লিচু আসবে।’

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মো. মোজদার হোসেন বলেন, ‘লিচুর এমন একটি ফল যা মানুষকে আকর্ষণ করবেই। তাই এই ফলে খুব একটা লোকসান হয় না। তবে কোন মৌসুমে ফলন একটু কম আবার কোনো মৌসুমে বেশি হয়। তবে প্রতিবছর লিচুর আবাদ বাড়ছে। চলতি মৌসুমে গত বছরের চেয়ে ৫ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ বেশি হয়েছে। তুলনামূলকভাবে এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও কিছুটা বেশি। গত বছরের চেয়ে এবছর ১০৭.৯৮ মেট্রিকটন লিচু বেশি উৎপাদন হতে পারে বলে আশা করা যাচ্ছে।’

এএইচ/এস