দুদকের সক্ষমতা বেড়েছে তৎপরতা কমেছে

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সংখ্যা ২২টি থেকে বাড়িয়ে গত দুই বছরে ৩৬টি করা হয়েছে। একই সময়ে সংস্থাটিতে ৪ শতাধিক নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে আরও কয়েকশ কর্মীকে। তারপরও বাড়েনি দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড; বরং জনবল বাড়ার পরের বছর দুদকের অনুসন্ধান ও মামলা কমেছে। দুদকের গত ছয় বছরের কর্মকাণ্ডের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া যায়।

দুদক ২০২২ সালে নতুন ১৪টি সমন্বিত জেলা কার্যালয় চালু করে। একই বছর ৪০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১১৪ জন সহকারী পরিচালক এবং ১৩৭ জন উপসহকারী পরিচালক। এ ছাড়া ১০৯ জন কনস্টেবল, আটজন আদালত পরিদর্শক ও ১৪ জন গাড়িচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই বছর আরও ১৩২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি হয়।

এর এক বছর পর অর্থাৎ ২০২৩ সাল শেষে দেখা গেল দুদকের দুর্নীতিবিরোধী কর্মকা- কমেছে। ২০২৩ সালের শুরুতে কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরও সফলতা না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক থেকে তখন বলা হয়েছিল, এত তাড়াতাড়ি সক্ষমতার হিসাব নেওয়া যায় না। জনবল বৃদ্ধি, পদোন্নতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রসহ সার্বিকভাবে দুদকের যে পরিধি বেড়েছে তাতে করে আগামীতে অনুসন্ধান, মামলা ও তদন্তে গতি আসবে। এই বক্তব্যের এক বছর পর এসে গত বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংস্থাটি অনুসন্ধান, মামলা, অভিযোগপত্র বাড়েনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমুখী অবস্থান নিয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় গত বছর দুদকের কর্মকা- কমে যাওয়ার বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

দুদকের গত ছয় বছরের দুর্নীতি দমন কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছর ৮৪৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে দুদক। একই বছর ৪০৪টি মামলা এবং ৩৬৩টি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। অথচ এর আগের বছর ২০২২ সালে ৯০১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছিল দুদক। ওই বছর ৪০৬টি মামলা ও ২২৪টি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। তার আগের বছর ২০২১ সালে ৮৯১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছর ৩৪৭টি মামলা এবং ২৬০টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০২০ সালে ৯৪৮টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। মামলা করা হয় ৩৪৮টি এবং ২২৮টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

২০১৯ সালে ১ হাজার ৭১০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিয়েছিল দুদক। একই বছর ৩৬৩টি মামলা এবং ২৬৭টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর আগের বছর ২০১৮ সালে ১ হাজার ২৬৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছর ২১৬টি মামলা এবং ২৩৬টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

দুদকের দায়ের করা মামলাগুলোর রায়ে সাফল্যের ক্ষেত্রেও জনবল বৃদ্ধির প্রতিফলন ঘটেনি। দেখা গেছে, গত বছরের রায় হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে দুদকের মামলায় ৬৭ শতাংশ এবং আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মামলায় ১৬ শতাংশ সাজা হয়েছে। এর আগের বছর ২০২২ সালে দুদকের মামলায় ৬৪ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলায় ৩৬ শতাংশ, ২০২১ সালে দুদকের মামলায় ৬০ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলায় ৩০ শতাংশ সাজা হয়। ২০২০ সালে কমিশনের মামলায় ৭২ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলায় ৪৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে দুদকের মামলায় ৬৩ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলয় ৪০ শতাংশ, ২০১৮ সালে দুদকের মামলায় ৬৩ শতাংশ এবং ব্যুরোর মামলায় ৫০ শতাংশ সাজা হয়।

রাজধানীর সেগুনবাগিচাসহ আটটি বিভাগীয় ও ৩৬টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ জমা দেওয়া যায়। গত বছর দুদকে দুর্নীতি সংক্রান্ত মোট ১৫ হাজার ৪৩৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যদিও আগের বছর ২০২২ সালে আরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছিল। ওই বছর ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের মহামারীর সময় ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৭৬৯টি অভিযোগ, ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগ, ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ

এবং ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ৬০৬টি জমা পড়ে। জমা পড়া অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানাধীন অভিযোগ ছাড়াও প্রতিবছর বেশকিছু অভিযোগ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে পাঠিয়ে থাকে দুদক।

দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে গত বছরই সবচেয়ে কম সংখ্যক অভিযোগ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২৩ সালে ৯১৩টি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এর আগে ২০২২ সালে ৩ হাজার ১৫২টি, ২০২১ সালে ২ হাজার ৮৮৯টি, ২০২০ সালে ২ হাজার ৪৬৯টি, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬২৭টি অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে পাঠানো হয়।

দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে আগের বছরের দুর্নীতিবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। রীতি অনুযায়ী এ প্রতিবেদন চেয়ারম্যানসহ অপর দুই কমিশনার সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করে থাকেন। এরপর দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনাও করা হয়। এবার দুদকের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল করতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সৌজন্য সাক্ষাৎ পায়নি কমিশন, যা দুদকের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। তবে গত বুধবার দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মো. শাহরিয়াজ বঙ্গভবনে এ প্রতিবেদন পৌঁছে দেন। গতকাল পর্যন্ত এ বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গেও আলোচনায় বসেনি কমিশন।

দুদকের কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে সচিবের দপ্তর থেকে জনসংযোগ দপ্তরের মাধ্যমে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরে দুদক জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে এ বিষয়ে কমিশনের কোনো বক্তব্য নেই বলে জানান।

এদিকে সোমবার অপর এক ব্রিফিংয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনের কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে জানতে চাওয়া হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

দুদকের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেখানে অফিসের সংখ্যা বাড়ল, কর্মকর্তা-কর্মচারী সংখ্যাও বৃদ্ধি পেল; সেখানে স্বাভাবিকভাবেই দুদকের কাজের ফলও বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখানে না হওয়াটা অস্বাভাবিক ঘটনা। এর কারণ দুদকই বলতে পারবে।’

সাবেক এই মহাপরিচালক আরও বলেন, দুদকের মামলা গুণগত দিক থেকেও পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই ছোটখাটো বিষয়ে যে কাজ করা হতো এখনো সেটাই করা হচ্ছে। বড় ধরনের দুর্নীতির যে সব অভিযোগ আছে সেগুলোর অনুসন্ধান করে মামলা করতে পারলেই দুদকের সমালোচনা দূর হতো। দুদক এত সক্ষমতা ও শক্তি পাওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের পুরনো সমালোচনা দূর করতে পারেনি। এ ব্যাপারে তারা উৎসাহিত বা আগ্রহী নয়। এখন থেকে দুদককে সচেষ্ট হওয়া উচিত।