দিনাজপুরে ৫ বছর ধরে খাঁচায় বন্দি শিশু!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বিরল রোগে আক্রান্ত ৬ বছর বয়সের শিশুকন্যা নুর-এ জান্নাত দীর্ঘদিন ধরে বাঁশের খাঁচায় বন্দি। মেয়েটি এখন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

একটি গ্রুপ অব কোম্পানির সহযোগিতায় এক বুক আশা নিয়ে মেয়েকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে তার দিনমজুর বাবা-মা। তবু ১০টি শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবে কি না? এমন আশা আর শঙ্কার মধ্যে রয়েছে তার দিনমজুর বাবা-মা।

দিনাজপুরের সদর উপজেলার কমলপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ জয়দেবপুর গ্রামের সিদ্দিক আলী ও ফেন্সি আরার একমাত্র কন্যা নুর-এ জান্নাত। জন্মের এক বছরের মধ্যেই বাবা-মা জানতে পারেন একটি বিশেষ রোগে আক্রান্ত সে।

কিছুক্ষণ পরপরই নিজের শরীরে নিজেই আঘাত করে সে। যাতে করে করে মুখমণ্ডলসহ শরীরে ক্ষত হয়েছে। নিজের শরীরে আঘাত করার আচরণই নয়, ঠিকভাবে কথা বলতে ও ঠিকভাবে চলাফেরাও করতে পারে না সে। কোল থেকে নামতে চায় না ও খেতেও চায় না নুর-এ জান্নাত।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বিবাহের এক বছরের মাথায় নুর-এ জান্নাতের জন্ম। জন্মের পর সে কান্না করেনি, আক্রান্ত হয়েছিল টাইফয়েডে। ওই সময় চিকিৎসকরা তাদের জানান, এক মাস পরেই কান্না করবে নুর-এ জান্নাত। এক মাস পর কান্না করে ঠিকই, কিন্তু জ্বর ও আমাশয় সবসময় লেগেই থাকত।

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্রসহ চিকিৎসকরা পুষ্টিকর খাবারের পরামর্শ দেন। জন্মের এক বছরের মধ্যেই বাবা-মা জানতে পারেন আর ১০টা শিশুর মতো স্বাভাবিক নয় সে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারেন তারা।

নুর-এ জান্নাত হাটতে পারে না, অথচ ছাড়া পেলেই কিছুক্ষণ পরপরই হাত দিয়ে নিজেই নিজের মুখমণ্ডলে ক্ষত করে, শক্ত কিছু দিয়ে শরীর ও মাথায় আঘাত করে, আগুনের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়। পরে জান্নাতের নানা বাঁশ দিয়ে একটি বিশেষ খাঁচা তৈরি করে দেন।

সেই খাঁচার মধ্যে তাকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয় দিনের বেশির ভাগ সময়ই। কারণ এই পরিবারে দিনমজুর বাবা কাজে না গেলে আহার জুটবে না, আর মাকেও করতে হয় সাংসারিক কাজ। মেয়ে ছাড়া থাকলে কোন সময় কোন অঘটন ঘটে যায়, তার ভয়েই বাধ্য হয়েই খাঁচায় বেঁধে রাখেন বাবা-মা।

জন্ম থেকেই শুরু, আর এখন নুর-এ জান্নাতের বয়স ৬ বছর ২ মাস। সুস্থ করে তোলার আশায় শিশুটির বাবা-মা ইতিমধ্যেই অনেক চিকিৎসা করিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।

শিশুটির মা ফেন্সি আরা বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই রোগবালাই লেগেই আছে নুর-এ জান্নাতের। এরই মধ্যে তার অস্বাভাবিক আচরণের জন্য বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছি। সবাই রোগ সেরে যাবে আশ্বাস দিলে এখনও কোনো উন্নতি হয়নি। তবে কয়েক মাস ধরে সে কিছুটা হাটতে পারে, কথাও বলে কিছু কিছু। চিকিৎসকরা বলেছেন, উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু দিন আনি দিন খাই সংসারে যেখানে দুবেলা খাবার জুটানোই দায়, সেখানে ভালো চিকিৎসা জুটবে কীভাবে?’

তিনি বলেন, ‘ওর বাবা দিনমজুর। সকাল বেলাতেই কাজে চলে যান। আর আমাকে সংসারের বিভিন্ন কাজকর্ম করতে হয়। বাচ্চাটাকে দেখার মতো কেউ নেই। আর তাই জান্নাতের নানা এই খাঁচাটা তৈরি করে দিয়েছেন, যেখানে তাকে বেঁধে রাখতে হয়।’ দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যাপক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এসএম ওয়ারেস জানান, শিশুটি সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত। উপসর্গভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করলে শিশুটিকে স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থা থেকে ২ বছর পর্যন্ত অক্সিজেন, আয়োডিন ও পুষ্টিহীনতার কারণে গ্রোয়িং ব্রেন ইনজুরিতে এই রোগ হতে পারে বলেও ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক।

নুর-এ জান্নাতের বাবা সিদ্দিক আলী বলেন, ‘গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি যা কিছু ছিল তাই বিক্রি করে মেয়ের চিকিৎসা করেছি। কিন্তু এখন আর পারছিলাম না। কী করব, কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যদি সরকার কিংবা বিত্তবান লোকজন ওকে সুস্থ করে তুলবার কোনো সহযোগিতা করে তাহলে তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। অবশেষে মেয়েটির চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এসেছে বসুন্ধরা গ্রুপ।

বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগিতায় গত ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। গ্রিন লাইফ হাসপাতালের ১২তলায় ১২০৭নং বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছে শিশুটি।

বুধবার নুর-এ জান্নাতের মা ফেন্সি আরা বেগম জানায়, তিন দিন ধরে হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে রয়েছেন তারা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। চলছে প্রাথমিক চিকিৎসাও। হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ বসুন্ধরা গ্রুপ বহন করলেও পকেটে টাকা না থাকায় ঢাকায় থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের। এরপরও একমাত্র মেয়ে স্বাভাবিক হয়ে হেঁটে খেলে দুরন্তপনায় মিশে আর ১০টি শিশুর মতোই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করবে-এমন আশা আর স্বপ্ন নিয়েই তারা হাসপাতালে রয়েছেন।