তেলের দাম বৃদ্ধি, রাজশাহীর চরের কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আগে নদীর এপারে যখন লিটার প্রতি ডিজেলের দাম ছিল ৮০ টাকা, তখন পদ্মার ওপারে ১০০। আর এখন নদীর এপারেই দাম ১১৪ টাকা। ওপারে ১৩০। সব সময় এভাবে বাড়তি দামেই তেল কিনে চাষাবাদ করতে হয় চরাঞ্চলের কৃষককে। বাড়তি খরচে চাষাবাদ করলেও তারা ফসলের দাম পান নদীর এপারের তুলনায় কম।

শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে ডিজেলের লিটার প্রতি মূল্য একলাফে ৩৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে যখন এ সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, তখন চরের অধিকাংশ কৃষকই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন সকালে হঠাৎ এ খবর শোনার পর তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। বাড়তি খরচের চিন্তায় তারা হতাশায় ভুগছেন। সারের মূল্য বৃদ্ধির পর পরই সেচ খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।

রাজশাহীর মাঠে মাঠে সাধারণত বিদ্যুৎ চালিত গভীর নলকূপের মাধ্যমেই সিংহভাগ কৃষক জমিতে সেচ দেন। এ পারের অল্প সংখ্যক কৃষক সেচের জন্য ডিজেল চালিত শ্যালো ইঞ্জিনের ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু রাজশাহীর পদ্মা নদীর ওপারের চরগুলোতে চাষাবাদের প্রায় পুরোটাই হয় শ্যালো ইঞ্জিনের সেচে। চরের সামান্য কিছু জমি সৌর বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় তেলের দাম বৃদ্ধিতে আরও বিপদে পড়েছেন চরের কৃষক। চাষাবাদের কী হবে তা নিয়ে তাদের এখন দুশ্চিন্তা।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নটি নদীর ওপারে। এই চরে চাষাবাদে সেচ খরচের হিসাবটা দিলেন আমতলা গ্রামের কৃষক মো. রকি। তিনি জানান, প্রতি মৌসুমে শ্যালো ইঞ্জিনের মালিককেই দিতে হয় সাড়ে তিন থেকে চার মণ ধান। আবার সেচ নেওয়ার জন্য কৃষককে কিনে দিতে হয় তেল। ইঞ্জিন ও জমিভেদে বোরো ধানের ক্ষেত্রেই কৃষকের লাগে ৪০ থেকে ৬০ লিটার তেল। ধান ও তেল দেওয়ার হিসাবের বাইরে সেচ নিলে ঘণ্টা প্রতি গুণতে হয় ১০০ টাকা। ৬০০ মিলিলিটার থেকে এক লিটার তেলে এক ঘণ্টা চলে শ্যালো ইঞ্জিন। এখন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের খরচে পাওয়া যাবে না সেচের পানি।

রাজশাহীর পবা উপজেলার চরমাজারদিয়াড় গ্রামের কৃষক মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘সকালে ত্যাল লিতে যাইয়্যা হঠাৎ শুনি দাম বাইড়া গেলছে। গতকাল লিটারে ৮৮ টাকা লিয়্যাছে, আইজ লিলো ১৩০। আমি তো অবাক! আগেই মুনে করেন ধান করতে গেলে বিঘায় ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়্যাছে। ২০-২০ মুণ ধান পাইয়্যাছি। লাভ বলতে কিছু থাকত না। এখুন অবস্থা আরও খারাপ হইয়্যা যাবে। এখুন কীভাবে চলবো?’

চর আষাড়িয়াদহের আমতলা খাসমহলে জ্বালানি তেল বিক্রি করেন ইয়াকুব আলী। তিনি জানান, এপার থেকে চরে তেল নিয়ে যেতে লিটারে ৫ থেকে ৭ টাকা খরচ হয়েই যায়। তাই সরকারি মূল্যের চেয়ে চরে অন্তত ১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করতে হয়। এবার যেভাবে সারের পর তেলের দাম বাড়ল তাতে চরের কৃষকদের সমস্যা আরও বাড়বে।

আমতলা গ্রামের কৃষক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘কৃষকের তো আবার লজ্জা নাই। লস হলেও আমরা চাষ করি। এডাই নেশা। কিন্তু সরকারকেও এ বিষয়ে একটু খেয়াল করা উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে ধানের দাম কমপক্ষে দু’হাজার টাকা মণ হতে হবে। তাহিলে চরের কৃষকের জানডা বাঁচবে। তা না হোলে কৃষক মোর‌্যা শেষ হয়্যা যাবে।’

চর আষাড়িয়াদহ উচ্চবিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মনিরুল হক বলেন, ‘চরে যে কোন ফসলের ফলন ভাল হয়। কিন্তু এখানে উৎপাদন খরচ বেশি, ফসলের দাম কম। ধানের ক্ষেত্রেই পারের চেয়ে চরে মণপ্রতি ১০০ টাকা কম পান চাষিরা। তাই চরের কৃষকের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ও পরিবহন খরচের সাথে সমন্বয় করে চরের কৃষককে ফসলের দাম দিতে হবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মো. শামছুল ওয়াদুদ বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষিতে তেমন খারাপ প্রভাব পড়বে না। কারণ, এখন কৃষিযন্ত্রের বেশিরভাগই তো চলে বিদ্যুতে।’ চরে বিদ্যুৎ না থাকার কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘চরে কিছুটা খারাপ প্রভাব পড়বে। এটা কতটা, সেটা আমাদের স্টাডি করে দেখা হয়নি। আগে দেখি, তারপর বলব।’

জি/আর