তিন জেলায় বন্যার প্রকোপ, আরও বিস্তারের শঙ্কা

অব্যাহত ভারি বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তিন জেলা ফেনী, নেত্রকোনা ও হবিগঞ্জে বন্যা শুরু হয়েছে।

এর মধ্যে মুহুরী, কংস ও খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মুহুরীবাঁধ ভেঙে ফেনীর অন্তত ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অন্য জেলার নিম্নাঞ্চলও দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ঢলের পানিতে কক্সবাজারে একটি সেতু ভেঙে গেছে।

এছাড়া নদী ও পাহাড়ি ছরায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙনে কমিউনিটি ক্লিনিক ও মসজিদসহ অসংখ্য ঘরবাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে। বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করায় জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমন ধানের বীজতলা, বিভিন্ন সবজি ফসল ও শতাধিক পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে।

বিভিন্ন স্থানে পানিতে নিখোঁজ তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহ থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়।

বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা ফেনীর পরশুরাম মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। হবিগঞ্জে বাল্লায় খোয়াই নদী বইছে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপরে। আর নেত্রকোনায় কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে বইছে ২ সেন্টিমিটার ওপরে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) জানায়, অব্যাহত ভারি বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির কারণে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) এবং ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের (আইএমডি) গাণিতিক মডেল অনুযায়ী, আগামী তিন দিনের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা প্রদেশে আগামী ৭২ ঘণ্টা ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে।

এর ফলে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতলে দ্রুত বাড়তে পারে। এতে কয়েকটি স্থানে আকস্মিক বন্যা দেখা দিতে পারে।

এফএফডব্লিউসি বলছে, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও পদ্মার পানি বাড়ছে। যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে।

এর আগে এফএফডব্লিউসি ৬ জুলাইয়ের দিকে বন্যা শুরুর পূর্বাভাস দিয়েছিল। সেটি অনুযায়ী উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল বন্যাকবলিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পূর্বাভাসকৃত সময়ের আগেই এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলও বন্যাকবলিত হয়ে পড়ল।

লামা (বান্দরবান) : টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে লামা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাতটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টিরও বেশি স্থানে ছোট-বড় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

মাতামুহুরী নদী ও পাহাড়ি ছরায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ফলে কমিউনিটি ক্লিনিক ও মসজিদসহ অসংখ্য ঘরবাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে। বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করায় জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।

পানির তোড়ে আজিজনগর ইউনিয়নের উত্তরপাড়ার কমিউনিটি ক্লিনিকের (সিসি) গাইড ওয়ালটি ভেঙে গেছে এবং মূল ভবনে ফাটল ধরেছে। যে কোনো মুহূর্তে ভবনটি ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাহাড়ি ঢলে হুমকির মুখে পড়েছে হিমছড়িপাড়া জামে মসজিদ। মসজিদের মাঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

কক্সবাজার : ভারি বর্ষণ ও ঢলের পানির তোড়ে ঈদগাঁও নদীর সেতু তলিয়ে গেছে। সেতুর দুটি গার্ডার ও একটি পিলার ভেঙে গেছে। বৃহস্পতিবার সকালে জালালাবাদ ও পোকখালী ইউনিয়নের সংযোগ সেতুটি ঢলের পানিতে তলিয়ে যায়।

এ সময় সেতু পার হতে গিয়ে ১০ পথচারী আহত হয়। পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রফিক বলেন, সেতুটি ভেঙে যাওয়ায় দুই ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার বাসিন্দা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেতুটি দ্রুত পুনঃনির্মাণের দাবি জানান তিনি। সদর উপজেলা প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) : ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বাঁশখালী উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার পুকুরিয়া, সাধনপুর, কালিপুর, বৈলছড়ি, পৌরসভা, শিলকৃপ, চাম্বল, নাপোড়া ও পুইছুড়িতে পানি ঢুকেছে। এতে কয়েকটি মাটির ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈলছড়ির বাসিন্দা কবির আহমদ জানান, ঢলে সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তার মাটির ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।

গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোতের সৃষ্টি হওয়ায় দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট ও ঘাটসংলগ্ন কয়েকটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিনটি পয়েন্টে ৫০ মিটার এলাকার জিও ব্যাগ ধসে গেছে। এতে করে বড় ধরনের ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে ফেরিঘাট ও সংলগ্ন মজিদ শেখের পাড়ার দেড় শতাধিক পরিবার। গোয়ালন্দের ইউএনও আজিজুল হক খান মামুন বলেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কুড়িগ্রাম : উজানের পানির ঢল ও ভারি বর্ষণে কুড়িগ্রামের তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জেলার নদ-নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। এ সপ্তাহে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা করছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড।

গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে কিছুটা কমলেও ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বেড়ে বিপদসীমার ১৫ সেমি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সবকটি পয়েন্টে বাড়তে শুরু করেছে।

ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) : ভারি বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে ধরলা, বারোমাসিয়া ও নীলকমল নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে স্বল্পমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীতীরবর্তী হাজারো মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার শিমুলবাড়ী এলাকার শেখ হাসিনা ধরলা সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে ধরলার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে নদ-নদী অববাহিকায় একটি স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

শেরপুর : ঝিনাইগাতী উপজেলা সদর, হাতিবান্দা ও ধানশাইল ইউনিয়নের প্রায় ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মহারশী নদীর দিঘীরপাড় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে চতল, মাটিয়াপাড়া, রামনগর, সুরিহারা, দড়িকালিনগর, কালিনগর, সারিকালিনগরসহ ১০টি গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি ও নিমাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। এতে আমন ধানের বীজতলা, বিভিন্ন সবজি ফসল ও শতাধিক পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে।

নালিতাবাড়ী (শেরপুর) : প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। দুই শতাধিক বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করেছে। এতে ঘরের আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। প্রায় প্রতিবছরই ভোগাই নদীর বাঁধ ভেঙে পড়ে। দুই বছর আগে বালির বস্তা দিয়ে ৩০০ মিটারের একটি নদী তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু এবার সে বাঁধ ভেঙে আবারও এলাকাবাসী সর্বস্বান্ত হয়েছে।

ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) : ধোবাউড়ায় অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন স্থানে পানি প্রবেশ করছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। এদিকে ঘোষগাঁও ইউনিয়নে ঢলের পানিতে লাখড়ি খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ কিশোর আবদুল হাকিমের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। বুধবার রাতে লাশ উদ্ধার করা হয়।

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) : পাহাড়ি ঢলের পানি দেখতে গিয়ে জাদুকাটায় নিখোঁজ একই পরিবারের দুই সন্তানের ভাসমান লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণকুল গ্রামের জাদুকাটা নদী থেকে দুই সহোদর মেরাজুল ইসলাম (১০) ও খাইরুল ইসলামের (৭) লাশ উদ্ধার করা হয়।

তারা জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের মস্তু মিয়ার সন্তান। বিশ্বম্ভরপুর থানার ওসি ইকবাল হোসেন জানান, সুনামগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে বিনা ময়নাতদন্তে পরিবারের কাছে লাশ দুটি হস্তান্তর করা হয়েছে।

দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) : পদ্মায় পানি হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডের কয়েকশ একর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া রায়টা-মহিষকুন্ডি রক্ষা বাঁধ, ভারত থেকে আসা বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের খুঁটিসহ অসংখ্য স্থাপনা হুমকির মুখে রয়েছে।

দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ বলেন, ভাঙন রোধে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নদীভাঙন রুখতে নদীপাড়ের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তাৎক্ষণিক জিও ব্যাগ ফেলার প্রক্রিয়া চলছে।

চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) : সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে স্থল, সদিয়া চাঁদপুর, ঘোড়জান, ওমারপুর, বাঘুটিয়া, খাষকপুখুরিয়া ও খাষকাউলিয়া ইউনিয়নের চরাঞ্চলের ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

এছাড়া অব্যাহত বৃষ্টি ও পানি বৃদ্ধিতে এনায়েতপুর ও গোপিনাথপুর ওয়াবদা বাঁধের জলাশয়গুলোতে নদীর পানি প্রবেশ করেছে। তলিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি গ্রামীণ কাঁচা সড়ক।

 

সূত্রঃ যুগান্তর