তাজরীন গার্মেন্টস: সাক্ষী সংকটে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বিচারকাজ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

পাঁচ বছর আগে ২৪ নভেম্বরের এই দিনটিতে চোখের সামনে আগুনে পুড়ে যায় আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন গার্মেন্টসের ১১৩ তাজা প্রাণ। আহত হন তিন শতাধিক মানুষ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে মালিকের অবহেলার বিষয়টি উঠে আসলে মামলা হয় মালিকসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। সেই মামলায় গত দুই বছরে সাক্ষী হাজির হয়েছে মাত্র সাত জন। যদিও সাক্ষী রয়েছে শতাধিক।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, মামলার সাক্ষীদের তলব করা হলেও তারা আসেন না, ফলে নতুন তারিখ নিতে হয়। আর আইন বিশ্লেষক ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, সাক্ষী হাজির না করে মামলা দুর্বল করার পুরনো কৌশল নেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকের মৃত্যু হয়, কিন্তু মালিকের বিচার হয় না কোনোদিন।

তাজরীন ফ্যাশনস ট্র্যাজেডির পাঁচ বছর হচ্ছে আজ শুক্রবার (২৪ নভেম্বর)। শতাধিক মানুষের প্রাণ, হাজারো মানুষের আহাজারি সঙ্গে নিয়ে ২০১২ সালের এই দিনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় কারখানাটি। এ সংক্রান্ত মামলায় অভিযোগ গঠন হয়েছে প্রায় আড়াই বছর আগে। কিন্তু এখনও বিচারকাজ শেষ হয়নি। আদালতে সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি খোন্দকার আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে সাক্ষীরা তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের গাফলতি আছে– এটি বলার সুযোগ নেই। এমনকি মামলায় সাক্ষীদের নামে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।’ সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ মামলায় সাক্ষীরা ওই এলাকার ভাড়াটিয়া। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাদের নাম সাক্ষী তালিকায় নেওয়ার সময় স্থায়ী ঠিকানা লিখে নেননি। এ জন্য আমরা কিছু সাক্ষী আনতে পারিনি।’ এ মামলায় সাক্ষী সংখ্যা ১০৪।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে বেঁচে যান রেহানা বেগম। ওই আগুনে সেদিন পুড়ে মারা যান তার বড় বোন আমেনা, দুলাভাই নজরুল ও তার ছেলে নয়ন ও ছেলের বউ মনিরা বেগম। কেবল রেহানা বেগমই নন, ওইদিন ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া অসংখ্য শ্রমিক ওই ঘটনার স্মৃতি বহন করছেন।

রেহানার মতো আরেক শ্রমিক জয়তুন জানান, এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন সেদিনের ঘটনা। তিনি বলেন, ‘আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য চার তলা থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছিলাম।’ সিঁড়ি থাকতে কেন লাফিয়ে পড়লেন–এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘কে নামতে দেবে? প্রডাকশন ম্যানেজার সিঁড়ির মুখের কেচি গেট বন্ধ করে রেখেছিল। তাদের তো কিছু না; প্রতি লাইন থেকে ঘণ্টায় ২০০ পিস মাল ডেলিভারি, ব্যস!’.

তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড

এত সাক্ষী চারপাশে, এত মানুষ বেঁচে থাকার পরও সাক্ষী না আসার প্রসঙ্গে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কর্মরত শাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কারখানা মালিকের শাস্তি হতে কখনও দেখা যায়নি, তাদের বাঁচানোর জন্য নানা কৌশল নেয় রাষ্ট্র।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল, আগুন লাগার বিষয়টি নাশকতা হতে পারে। এত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য কারখানা মালিকের অমার্জনীয় অবহেলাই দায়ী। এটি সুস্পষ্টভাবে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অপরাধ।’ তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের মালিক (ব্যবস্থাপনা পরিচালক)  দেলোয়ার হোসেনকে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

তাজরীনের ক্ষতিপূরণ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটকারী আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া  বলেন, ‘মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে আগে থেকেই বলছিলাম। সাক্ষীরা আসে না বলে রাষ্ট্রপক্ষের কিছু করার নেই–বিষয়টি এমন নয়। আমরা জানি, সরকারের এই মামলাটিতে বিশেষ দৃষ্টি আছে বলেই শোনা যায়। সাক্ষীদের স্থায়ী ঠিকানা ছাড়া অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন যিনি তারও এখানে দায় আছে, আদালত নিশ্চয় সেটি বিবেচনায় নেবেন। এখানে রাষ্ট্রপক্ষের বাড়তি দায়িত্ব আছেই, সাক্ষী আনার পুরো দায়িত্ব তার। মনে রাখতে হবে যারা মারা গেছেন, তারা প্রান্তিক মানুষ।’

অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। তাদের বিরুদ্ধে ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যু’র অভিযোগ আনা হয়।

বাংলা ট্রিবিউন