ডিজিটাল ক্যামেরা কিনতে প্রয়োজনে সুদূর জার্মানি যাও

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাঙালিদের নরকে নাকি কোনো প্রহরী নেই। কারণ সেই নরক থেকে কেউ পালাতে চাইলে, অন্যরা তাকে আটকে রাখে। বাঙালিদের কেউ ওপরে উঠতে চাইলে নাকি বাকিরা সবাই তার পা ধরে টেনে নামাতে ঝুলে থাকে। বাঙালির হিংসুটেপনার আরেকটি উদাহরণ দেখলাম গত দুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। সামাজিক মাধ্যম থেকে তা উঠে এসেছে গণমাধ্যমেও। এমনকি বিবিসি বাংলাও তাতে তাল মিলিয়ে বিষয়টির একটি আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নুরুল ইসলাম, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ লিয়াকত আলি খান এবং অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শিপলু জামান- অনেক কায়দা কানুন করে একটা জার্মানি ট্যুর ম্যানেজ করেছেন। এখন আমরা সবাই মিলে উঠে পড়ে লেগেছি তাদের ঠেকাতে। আমরা যেতে পারছি না, তারা যাচ্ছে; এই হিংসায় আমাদের কলিজা পুড়ে যাচ্ছে। আর সেই কলিজা পোড়া গন্ধ আমরা ছড়িয়ে দিচ্ছি ফেসবুকের স্ক্রিনে আর পত্রিকার পাতায়। কোনো মানে অাছে। মানুষের উন্নতি আমাদের একদম সহ্য হয় না।
কায়দাটা অবশ্য তারা মন্দ করেননি। প্রধানমন্ত্রীর কাভারেজের জন্য একসেট ডিজিটাল ক্যামেরা ও সরঞ্জামাদি কেনা হবে। কেনার সব প্রক্রিয়া শেষ। এখন প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনের জন্য এই তিন দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা জার্মানি যাচ্ছেন। অবশ্যই তারা দেশপ্রেমিক, প্রধানমন্ত্রীর কাভারেজের জন্য যে ক্যামেরা আনা হচ্ছে, হিটলারের জাত সেই ক্যামেরা ঠিকমত দিল কিনা তা তো যাচাই করে দেখতে হবে। হতে পারে তারা দেখালো তাল, পরে চুলের হিন্দি প্রতিশব্দ প্যাক করে পাঠিয়ে দিল। আমরা অনেক সময় চিংড়ি রপ্তানি করার সময় ওজন বাড়াতে পেড়েক-পাথর-তামা দিয়ে প্যাক করে দেই। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা জানি জার্মানদেরও বিশ্বাস নেই। তাই প্যাক করার সময় বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতি অতি জরুরি। আপনারা বলতে পারেন তিনজন কেন, একজন গেলেই তো হতো। ভাই ক্যামেরা মানে কিন্তু শুধু ক্যামেরা নয়; এর সাথে লেন্স আছে, কার্ড আছে, ব্যাটারি আছে, ট্রাইপড আছে। এতকিছু একজনের পক্ষে ইন্সপেকশন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর প্যাক করার সময় বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে বিষয়টা দেখা দরকার। অন্তত চার জন হলে চার কোণা থেকে বিষয়টা দেখতে পারতেন। তাই আমি দাবি জানাচ্ছি, সম্ভব হলে শেষ মুহুর্তে টিমে আরেকজন অন্তর্ভুক্ত করার। টিম বড় করার ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় নিশ্চয়ই মাথায় ছিল, সারাদিনের অক্লান্ত ইন্সপেকশনের পর হোটেলে ফিরে তারা নিশ্চয়ই একটু খানাপিনা করতে চাইবেন। বিদেশে গিয়ে একটু দল বড় না হলে ঠিক মাস্তি করা যায় না। আর ২৫-৩১ জুলাই টানা ছয়দিন টানা ইন্সপেকশন করা কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। দলে ভারি হলে তারা কাজটা ভাগাভাগি করে দক্ষতার সাথে করতে পারবেন। তখন জাতি কোয়ালিটি প্রি শিপমেন্ট ইন্সপেকশন পাবে। তবে হাসি ঠাট্টা বাদ দিয়ে সিরিয়াসলি বলি, প্রি-শিপমেন্টটা যদি সত্যিই জরুরি হয়, তাহলে ডিজিটাল ক্যামেরা বোঝে, এমন একজনকে নেয়া উচিত। আমি নিশ্চিত যে তিনজন যাচ্ছেন তারা আর যাই বুঝুন, ডিজিটাল ক্যামেরা বিষয়টা বোঝেন না। এটা অবশ্য তাদের দোষ নয়। সবাইকে সবকিছু বুঝতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এক যুগ টেলিভিশনে কাজ করেও আমি নিজেকে ডিজিটাল ক্যামেরা ইন্সপেকশনের যোগ্য মনে করি না। অামাদের অফিসে এ ধরনের কোনো ইন্সপেকশনের প্রশ্ন আসলে আমি হেড অব ব্রডকাস্ট এবং চিফ ক্যামেরাম্যানের নামই দেবো। তাই এই টিমেও অন্তত একজন টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন লোক থাকা দরকার। পত্রিকায় যে তিনজনের নাম পড়েছি, তাদের সে জ্ঞান থাকার কথা নয়। তবে সবচেয়ে বড়। কথা হলো, প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনটা কবে থেকে এত জরুরি হয়ে গেল? এখন তো সব ভার্চুয়ালি হয়। প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন আবশ্যিক হলে বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হয়ে যেতো। ব্যবসা-বাণিজ্য চলে আস্থা-বিশ্বাস-সততায় ভর করে। আমাদের মধ্যে জিনিসগুলো নেই তো, তাই ভাবি, কারো মধ্যেই নেই। ইমাম ভাবে চোরও বুঝি নামাজ পড়তে ওজু করতে ঘাটে এসেছে। আর চোর ভাবে ইমামও বুঝি সারারাত চুরি করে মুখ ধুতে ঘাটে এসেছে।
বলছিলাম কায়দার কথা। প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে তারা তিনজন তাদের সাফল্যের নৌকা বন্দরে প্রায় ভিড়িয়ে ফেলেছিলেন। সাফল্য যখন ফ্লাইটে ওঠার দূরত্বে, তখনই নৌকা আর বন্দরের মাঝখানে লাফ দিয়ে পড়লো কিছু মূর্খ সাংবাদিক আর কিছু বিচ্ছু ফেসবুকার। যাদের কোনো কাজ নেই, আরেকজনের সাফল্যে বাগড়া দেয়া ছাড়া। এরা উল্টাপাল্টা লিখে তেতুল পাবলিকের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুন্ন করছে। এরা নিশ্চয়ই ছদ্মবেশি আইএস, নাহলে বিএনপি-জামাত তো অবশ্যই। সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড এদের সহ্য হয় না। আর সাংবাদিকদেরও বোঝা উচিত ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’ এই জমানা বাতিল হয়ে গেছে। এখন উন্নয়ন সাংবাদিকতার যুগ। সরকারের উন্নয়নের জোয়ার জনগণের কাছে পৌছে দিতে চাই উন্নত ডিজিটাল ক্যামেরা। তাই এই ক্যামেরা আনার পথে কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল হবে।
সাংবাদিকদের হইচইটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সফরে কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ব্যয় হচ্ছে না। পুরো ব্যয় বহন করবে ক্যামেরা সরবরাহকারী কোম্পানি। তাহলে আর বাংলাদেশের তিনজন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তার সফর নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন। ট্যুরটি না হলে তো খরচ বাঁচবে জার্মান কোম্পানির, বাংলাদেশের তো কোনো লাভ নেই।
বিবিসির প্রশ্নের জবাবে ডিএফপি মহাপরিচালক দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। প্রথম তথ্যটি হলো মূল ক্যামেরার দাম ৩৫ লাখ টাকা। আরেকটা তথ্য হলো, একই কাজে গতবছর দুজন জার্মানি ঘুরে এসেছেন। তাদের রিপোর্টে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই মহাপিরচালক এবার নিজেই যাচ্ছেন।
তথ্য দুটি শুনে আমার একটি অঙ্কের গল্প মনে পড়ে গেল। ইন্সপেক্টর তার প্রিয় পোষা কুকুর নিয়ে স্বুল পরিদর্শনে গেছেন। পরিদর্শন শেষে পন্ডিত মশাই ছাত্রদের বললেন, ইন্সপেক্টরের পোষা কুকুরের পেছনে মাসে খরচ ৭৫ টাকা। সেই কুকুরটি আবার খোড়া, তার একটি পা নেই। আর পন্ডিত মশাইয়ের পরিবারের সদস্য পাঁচ, তার মাসিক বেতন ২৫ টাকা। তাহলে পন্ডিত মশাইয়ের পরিবার ইন্সপেক্টরের তিন পেয়ে কুকুরের কয়টি ঠ্যাংএর সমান? এবার আমরা একটু অঙ্ক করি। ক্যামেরার দাম ৩৫ লাখ টাকা। দুই দফায় পাঁচ জন সরকারি কর্মকর্তার সফরে একেজনের পেছনে গড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হলে মোট খরচ হবে ১৫ লাখ টাকা। ক্যামেরা কোম্পানি নিশ্চয়ই তাদের দুঃস্থ তহবিল থেকে এই সফর স্পন্সর করছে না। নিশ্চয়ই ক্যামেরার দামেই সেটা অন্তর্ভূক্ত করা আছে। ১৫ লাখ টাকার ভ্রমন ব্যয় বাদ দিলে কয় টাকায় ক্যামেরাটি কেনা যেতো?
এইটুকু পড়ে নিশ্চয়ই আপনার নিশ্চয়ই ক্ষেপে উঠেছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকা জনগণের কল্যাণেই ব্যয় করা উচিত। আরে ভাই, অত ক্ষেপেন ক্যান, যে তিন কর্মকর্তা যাচ্ছেন, তারাও তো জনগণেরই অংশ। তাদের বিদেশ সফরও তো জনগণের সেবাই। নাকি?

লেখক: প্রভাষ আমিন

সাংবাদিক ও লেখক

বি:দ্র: লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া