ডলার সংকটের খড়্গ হৃদরোগ চিকিৎসায়

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

দুই বছর আগে শুরু হওয়া ডলার সংকটের খড়গ নেমেছে হৃদরোগের রোগীদের ওপর। ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো এলসি বা ঋণপত্র খুলতে না পারায় পেসমেকারের মতো জীবনরক্ষাকারী মেডিক্যাল ডিভাইস আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন রোগীরা। হাসপাতালের শয্যায় থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন বহু রোগী।

আমদানিকারকরা বলছেন, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ডলার সমস্যা শুরু হয়। মাঝে কিছুদিন স্বাভাবিক হলেও গত সাত মাস ধরে সংকট চলছে। আগে লো-মার্জিন অর্থাৎ ২০ শতাংশ মার্জিন দিলেও এলসি খোলা যেত, এখন বেড়ে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন লাগছে। আগে এলসি খোলার জন্য ব্যাংকে আবেদন করলে দু-একদিনেই পাওয়া যেত। ডলার সংকটের কারণে বর্তমানে দেড় মাসেও হচ্ছে না।

দুই মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন নোয়াখালীর ফাতেমা বেগম (৬০)। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাকে নেওয়া হয় রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি)। চিকিৎসক জানিয়েছে, পেসমেকার লাগাতে হবে। ফাতেমার ছেলে জানে আলম জানান, ‘গত বৃহস্পতিবার থেকে একটা পেসমেকারের জন্য ঘুরছি, কিন্তু এখনো পাইনি। আগামী রবিবার (আজ) দেওয়ার কথা। ডাক্তার বলেছে হাতে পেলে চিকিৎসার পরবর্তী ধাপে যাবে।’

অন্যদিকে পাঁচ দিন অপেক্ষার পর পেসমেকার সংগ্রহ করতে পেরেছেন রুস্তম আলী (৫২)। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে গত বুধবার হাসপাতালের বিল ছাড়াই শুধু পেসমেকার কিনতে হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে মেডট্রোনিক প্রাইভেট লিমিটেড, বায়োট্রোনিক বোস্টন সায়েন্সসহ ৯টি কোম্পানির ৫১ ধরনের পেসমেকার আমদানি করা হয়। ২০১৯ সালে এসব পেসমেকারের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেয় সরকার। সে সময়ে লাখ টাকার নিচে পেসমেকার মিললেও বর্তমানে সর্বনিম্ন পেসমেকারের দামও ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

হার্ট দুর্বল হয়ে পর্যাপ্ত স্পন্দন তৈরি করতে না পারলে পেসমেকার যন্ত্র বসাতে হয়। বাংলাদেশে প্রতি মাসে এর চাহিদা ২৫০ থেকে ২৬০টি। যার এক-তৃতীয়াংশ আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হার্টের সরঞ্জাম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান দ্য স্পন্দন লিমিটেড।

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী অংশুমান মালাকার বলেন, ‘দেশে হৃদরোগীদের চিকিৎসায় বর্তমানে গড়ে ২৫০টি করে পেসমেকার এবং ১৫টির মতো হাইভোল্টেজ ডিভাইস দরকার হয়। আমাদের মার্জিন আছে ১১০টা। যেটি দিয়ে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ চাহিদা মেটানো যায়। নিয়ম অনুযায়ী ১০০টা পেসমেকার দরকার হলে ২০০টির মতো মজুদ থাকতে হয়। কিছুদিন আগেও ৫০টি পেসমেকার ছিল। এলসি খুলতে না পারায় সরঞ্জাম আনা সম্ভব হচ্ছে না।’

পেসমেকারের ভাল্বসহ হাঁটুর সার্জারির সরঞ্জামাদির দামও বেড়েছে। এসব সরঞ্জাম আমদানিকারকদের একটি মেরিল সায়েন্স। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রধান আব্দুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘রিঙের বেলুন, অর্থপ্রেডিক্সের সরঞ্জাম কোনোকিছুই ঠিকমতো আনা যাচ্ছে না। ব্যাংকে ডলার না থাকায় এমন অবস্থা। দুই বছর ধরে এই পরিস্থিতি। রিজার্ভ না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা বলে ব্যাংকগুলো বারবার ফেরত দিচ্ছে। আগে যেখানে এক সপ্তাহের মধ্যে হতো, এখন দেড় মাসেও হয় না। ১০ হাজারের এলসি ১৫ দিন ধরে পড়ে আছে।’

হার্টের রিঙের দাম বেঁধে দেওয়ার পর এখন পেসমেকারের দামও বেঁধে দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের একজন সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘ডলার সংকট ছিল আছে, তাই বলে ৬৫ হাজার টাকার পেসমেকার দেড় লাখ টাকা হতে পারে না। তবে সংকট আছে এটা বলাই যায়। কোম্পানিগুলো এই মুহূর্তে দিতে পারছে না। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টরা এটাতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।’

ডলারের দামের দোহাই দিয়ে পেসমেকার ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার। তিনি বলেন, ‘যারা আমেরিকান কোম্পানি তারা বেশি রাখছে, আবার ইউরোপিয়ানরা কম রাখছে। যেটা ছিল দেড় লাখ, সেটি হয়ে গেছে আড়াই লাখ। পেসমেকার এখন মধ্যবিত্তের সীমার বাইরে।’

তবে ডলার সংকটের সঙ্গে পেসমেকারের দাম বৃদ্ধির সম্পর্ক নেই বলে মনে করেন হৃদরোগ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামালউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সংকট কিছুটা আছে। রিঙের দামের পর পেসমেকারের দাম কমানোর বিষয়ে ডিজিডিএ উদ্যোগ নিতে পারে।’

চিকিৎসকরা সুপারিশ করলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর পেসমেকারের দাম কমানোরও উদ্যোগ নেবে বলে জানান ডিজিডিএর মুখপাত্র মো. নুরুল আলম। তিনি বলেন, ‘এলসি জটিলতা থাকলে আমাদের কছে আবেদন করতে পারে কোম্পানিগুলো। সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুমোদন করবে ডিজিডিএ। কিন্তু ডলার সংকটের কথা বলে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই।’