জেরুসালেম ইস্যুতে মুসলিমদের সংহতি কতটা বাড়বে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপ হয়ত আরব ও মুসলিম দুনিয়াকে নতুন করে সচেতন করে তুলতে পারে যে ওই এলাকায় শান্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমেরিকার যে ধ্যানধারণা তাদের হয়ত সে ব্যাপারে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল।

এখন যখন তারা বুঝতে পারছে যে আমেরিকা ইসরোয়েলেরই পক্ষ নিচ্ছে, তখন তাদের মনে হতে পারে যে তাদের অনুভূতি বা আবেগের তোয়াক্কা আমেরিকা করে না অথবা ওই এলাকার স্থিতিশীলতা নিয়ে আমেরিকার মাথাব্যথা নেই।

যে বিষয়টাতে মুসলিম বিশ্ব সবসময়েই অখণ্ড মনোভাব পোষণ করে এসেছে সেটা হল ফিলিস্তিনি ইস্যু। সিরিয়া নিয়ে তাদের মতভেদ থাকতে পারে, ইরাক নিয়ে তাদের মতের ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু যখন ফিলিস্তিনের বিষয় আসে এবং বিশেষ করে পবিত্র স্থান জেরুসালেম প্রসঙ্গে তারা অভিন্ন অবস্থান নেয়।

সামনের দিকে তাকাতে হলে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যেতে পারে, যেখানে এই ইস্যুতে অভিন্নতা প্রধান হয়ে উঠতে পারে এবং একটা প্রতীকী পর্যায়ে মুসলিম বিশ্বের সংহতি আরও জোরালো করে তুলতে পারে।

বিশেষ করে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, এবং তেল আভিভ থেকে জেরুসালেমে আমেরিকা দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।

মধ্য প্রাচ্যের পত্রিকাগুলোর শিরোনাম

এটা অবশ্য নতুন কোন ইস্যু নয়। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে আরেকটা ইন্তিফাদা যে হবে এটা ভাবা অযৌক্তিক কিছু নয়। হামাস ইতিমধ্যেই অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছে।

মুসলিম দুনিয়ায় একটা বিশ্বাস দানা বেঁধেছিল যে একটা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে দিয়ে সমাধানের একটা পথ, একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথ হয়ত তৈরি হয়েছে। কিন্তু অসলো চুক্তির ২৩ বছর পর আসলে কিছুই হয়নি। ওয়েস্ট ব্যাংক এবং জেরুসালেমে ৮ লক্ষ ইসরায়েলি বসতি তৈরি হয়েছে।

কাজেই এই সিদ্ধান্তের ফলে শান্তি প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধারের বদলে তার যে পুরোপুরিই মৃত্যু ঘটেছে এ ব্যাপারে এখন কারো মনেই যে আর সন্দেহ নেই সেটা বলা যায়।

আমাদের এখন মধ্য প্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ের মধ্যে থাকার কথা। এখন ট্রাম্প কীভাবে সেটা করবেন এবং একইসঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়াকে কীভাবে তিনি রক্ষা করবেন? এটা যে অসম্ভব এখন সে ধারণাটাই প্রকট হচ্ছে। জেরুসালেমের ভবিষ্যত রয়েছে এর মূলে। ইসরায়েলিদের কথা ভেবে যদি জেরুসালেমকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে শান্তি আলোচনায় ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাপ করার জন্য কী বাকি থাকবে?

বেথলেহেমে ফিলিস্তিনিদের জমায়েতের ওপর নজর রাখছে ইসরায়েলি সৈন্যরা, ৭ই ডিসেম্বর ২০১৭

অদূর ভবিষ্যতে এর একটা পরিণাম দেখা যাবে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ হবে, সহিংসতার হুমকি রয়েছে, আরেকটি ইন্তিফাদা হতে যাচ্ছে। এরপরেও কী ফল হবে তা স্পষ্ট নয়। শুধু যেটা স্পষ্ট সেটা হল মানুষ ক্ষুব্ধ।

এই ক্ষোভে সামিল হয়েছে ৫৬টি মুসলমান প্রধান দেশের ১৫০কোটি মানুষ, যা বিশ্বের জনসংখ্যার ২২ শতাংশের বেশি। কারণ মক্কা আর মদিনার পর জেরুসালেম তাদের সবার জন্য পবিত্র একটি স্থান।

এটা একটা অপমান এবং এর পেছনে কোন যুক্তি নেই। আমেরিকা কেন তার দূতাবাস সরিয়ে নিতে চাইছে, আর সেটা এখন কেন চাইছে? আসলে একটা পরাশক্তি চাইছে ইসরায়েলের যুক্তিকে স্বীকৃতি দিতে এবং সেই স্বীকৃতি তারা দিচ্ছে এমন একটা স্থানকে ঘিরে যেটা মুসলমানরা মনে করে পবিত্র এবং যেটা তাদের একান্ত নিজস্ব।

কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কি অন্য মতানৈক্যকে জোড়া দেবে? ৫৬টি মুসলিম প্রধান দেশের মধ্যে বহু বড়ধরনের মতানৈক্য আছে। সেগুলো সূক্ষ্ম, ব্যাপক এবং জটিল। জেরুসালেম ইস্যুর থেকেও সেগুলো অনেক বড়।

বেথলেহেমে সীমান্ত প্রাচীরের গায়ে ট্রাম্পের ছবিতে ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ

বেশিরভাগ মুসলমান প্রধান দেশ জেরুসালেম প্রশ্নে তাদের মতভেদ দেখাবে না কারণ ওই শহর মুসলমানদের জন্য অভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু এসব বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে যা কাটিয়ে ওঠা যাবে না।

অন্য যে বিষয়ে বড়ধরনের পরস্পরবিরোধিতা তৈরি হল, সেটা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে। পশ্চিমা দেশগুলো ইসলামী জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু মি: ট্রাম্প যে পদক্ষেপ নিলেন তা হল আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার এবং সবচেয়ে ভাল অস্ত্র।

এই দলগুলো এখন ভাবতেই পারে যে “দেখ, যে আমেরিকা আমাদের বিরুদ্ধে লড়ছে, তারা ইরাকে এবং সিরিয়ায় আমাদের শক্তি ধ্বংস করে দেবার পর এখন ইসরায়েলিদের পুরস্কৃত করছে, আরবদের নয়।” এর ফলে আমাদের এলাকায় সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, তার ঢেউ ইউরোপ এবং আমেরিকায় গিয়েও পৌঁছতে পারে। জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেবার পরিণামে সেখানে “প্রতিশোধমূলক তৎপরতা” চালানো হতে পারে।

জেরুসালেমের পুরনো অংশ, ইসলামের তৃতীয় সবচেয়ে পবিত্র স্থান

এই সিদ্ধান্ত জঙ্গীদের অনুকূলে কাজ করতে পারে, মধ্য প্রাচ্যে আমেরিকার যারা মিত্র আছে, যেমন মিশর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমীরাত এই সিদ্ধান্ত তাদের অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। আমি মনে করি এই সিদ্ধান্তে হিতে বিপরীতই হতে পারে।

ফিলিস্তিনি ইস্যুতে এটা হয়ত মানুষকে মাঠের আন্দোলনে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারবে। তবে একটা সংহতি গড়ে তোলার বদলে এর ফলে ওই অঞ্চল আরও অশান্ত হয়ে উঠবে।

এর বিপরীতমুখী দিকটা হল: এই পদক্ষেপ বিভিন্ন মুসলিম দেশের মানুষকে হয়ত একটা অভিন্ন জায়গায় নিয়ে আসতে সাহায্য করবে, কিন্তু একই সঙ্গে এই পদক্ষেপ উগ্রবাদ এবং জঙ্গী আদর্শকে আরও উদ্বুদ্ধও করতেও সাহায্য করবে।” বিবিসি বাংলা