চিকিৎসকের মৃত্যুতে কাঠগড়ায় ল্যাবএইড!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

‘একজন মানুষ হার্টের সমস্যা রয়েছে কিনা জানার জন্য সজ্ঞানে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, পরীক্ষা কক্ষে ঢুকলেন অথচ সেখান থেকে বের হলো তার লাশ—কেন মারা গেলেন, কীভাবে মারা গেলেন সে বিষয়ে কেউ কিছু বলছে না, কারও কাছ থেকে কোনও ব্যাখ্যা আমরা পাচ্ছি না।সেখানে কিছু একটা তো ঘটেছে, নইলে মানুষটা কেন মারা যাবেন? দেয়ার ইজ সামথিং রং…’ এসব মন্তব্য ডা. নাঈমুল হক শাম্মীর পরিবার, বন্ধু ও স্বজনদের। গত ১২ ডিসেম্বর ধানমণ্ডির ল্যাব এইড হাসপাতালে ডা. শাম্মীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই তার পরিবারসহ চিকিৎসকমহলে ঘুরেফিরে চালাচালি হচ্ছে এসব মন্তব্য।

 

বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বইছে আলোচনার ঝড়। এ ঘটনায় কৈফিয়ত তলবসহ চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাবর।আর ডা. নাঈমুল হক শাম্মীর স্ত্রী জানিয়েছেন, স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় ল্যাবএইডের বিরুদ্ধে মামলা করবেন তারা।

 

 

গত ১২ ডিসেম্বর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাঈমুল হক শাম্মী ধানমণ্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ভর্তি হন।সেদিনই এনজিওগ্রাম চলাকালীন সময়ে তার মৃত্যু হয়। ডা. শাম্মীর ‍মৃত্যুর এমন মৃত্যুর ঘটনাটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তার চিকিৎসক বন্ধুরা। তাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে এবং তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে ঘটনাটি তদন্তে চিঠি দেওয়া হয়েছে ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।

 

একই ঘটনায় বিএমএ মৌলভীবাজার শাখা ঘটনা তদন্তে চিঠি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাবর।বিএমএ মৌলভীবাজার শাখার সভাপতি ডা. মো. শাব্বির হোসেন খান স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে এনজিওগ্রাম করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি (ক্যাথল্যাবের ভেতরে অ্যানাস্থেটিস্টের উপস্থিতি, ক্যাথল্যাবে ডি-ফিব্রিলেটর, ভেন্টিলেটর থাকা) ছাড়াই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এনজিওগ্রাম করেন এবং করোনারি স্টেন্টিং এর পদক্ষেপ নেন বলে উল্লেখ করেছেন।

 

 

অপরদিকে, ডা. শাম্মীর এনজিওগ্রামের সময়ে সেখানে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন তাদের পারিবারিক বন্ধু ডা. রোকসানা আক্তার।কিন্তু তাকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি জানিয়ে ডা. রোকসানা বলেন, ‘মেডিক্যাল টার্মের বেসিক বিষয়গুলোও সেদিন সেখানে মানা হয়নি।এনজিওগ্রাম হার্টের একটি চিকিৎসা, সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ যেকোনও কিছুর জন্য চিকিৎসককে প্রস্তুত থাকতে হবে, মেডিক্যাল প্রসিডিউর মানতে হবে।’

 

 

তিনি বলেন, ‘একজন চিকিৎসক এবং পরিবারের সদস্য হিসেবে পরীক্ষা কক্ষে থাকতে চাইলে ডা. ওয়াদুদ আমাকে সেখান থেকে বের করে দেন। বাধ্য হয়ে এনজিওগ্রাম কক্ষের বাইরে মনিটরিং কক্ষে অপেক্ষা করি আমি। এনজিওগ্রাম কক্ষ ও মনিটরিং কক্ষের মাঝে শুধু একটি গ্লাস। সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছি অক্সিজেন সিচুয়েশন কমে যাচ্ছে। ভেতর থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছি অক্সিজেন আর ভেন্টিলেটর আনার জন্য। আমি সঙ্গে সঙ্গে মনিটরিং রুম থেকে বের হয়ে ভেন্টিলেটরের জন্য চিৎকার করেছি, সেখানে কোনও অ্যানাস্থেটিস্ট ছিল না। আমি চিৎকার করে ভেন্টিলেটরসহ অ্যানাস্থেলোজিস্টকে আনিয়েছি। যে কোনও স্বাভাবিক অপারেশনেও এসব রাখতে হয়, সেখানে একজন চিকিৎসকের এনজিওগ্রামের সময় ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ এসবের কিছুই রাখেনি। ডা. ওয়াদুদ তখন চিৎকার করছিলেন ভেন্টিলেটরের জন্য, অ্যানাস্থেলজিস্টের জন্য।’

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ইকবাল আর্সেলান বলেন, আমার স্বাক্ষরিত চিঠিই ল্যাবএইডে পাঠানো হয়েছে। ডা.শাম্মীর মৃত্যুতে অবহেলা করা হয়েছে বলে নানা অভিযোগ শুনতে পাচ্ছি। তাই তাদের (ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ) বক্তব্য জানার জন্য গত ১৭ ডিসেম্বর চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং সাত দিনের মধ্যে এই চিঠির জবাব দেওয়ার জন্য তাদেরকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।সে হিসেবে আগামী ২৪ ডিসেম্বর আমরা তাদের জবাব পাবো বলে আশা করছি।

 

ডা. ইকবাল আর্সলান আরও বলেন, ল্যাবএইডের বক্তব্য পাওয়ার পর বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন যদি তাতে সন্তুষ্ট না হয় তাহলে আমরা নিজেরাই তদন্ত করবো। আমরা অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীর বক্তব্যও নেবো।এদিকে, ডা. শাম্মীর মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গত ১৮ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালায়ের সচিবকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মৌলভীবাজার শাখা।

 

এ ঘটনায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) থেকে চিঠি পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ। ল্যাবএইড হাসপাতালের কর্পোরেট কমিউনিকেশন বিভাগের অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার সাইফুর রহমান লেলিন বলেন, ‘আমাদের কাছে চিঠি এসেছে, আর এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আমরা আগামী শনি অথবা রবিবারের মধ্যে তাদেরকে জানানো হবে।’

 

তিনি আরও বলেন, ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে বিষয়টি নিয়ে। তবে ঘটনাটি মিসকমিউনিকেশন দাবি করে সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে তেমন কোনও ত্রুটি ছিল না। ডা. শাম্মীকে এনজিওগ্রামের জন্য নেওয়া হলে তার তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। সেকথাও তার স্ত্রী এবং মাকে বলা হয়েছে। ওই সময়েই বোধহয় তার হার্ট অ্যাটাক হয় এবং পালসরেট কমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দিক থেকে যা যা করার সেগুলো করা হয়েছে। কিন্তু অক্সিজেন কমাটাই তার শুধুমাত্র সমস্যা ছিল না, তার আরও অন্য সমস্যাও ছিল, ফুসফুসও কাজ করছিল না। ওনার অনেকগুলো জিনিস ঘটেছিল একসঙ্গে।’

 

আপনাদের কোনও অবহেলা ছিল কীনা প্রশ্ন করলে সাইফুর রহমান বলেন, ‘এমনটার প্রশ্নই ওঠে না আর ডা. ওয়াদুদ চৌধুরীর মতো চিকিৎসকের ভুল করার কথাই না।’

 

তবে ডা. নাঈমুল হক শাম্মীর বন্ধু ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা জরুরি জানিয়ে বলেন, ‘‘ইলেকটিভ এনজিওগ্রাম করার জন্য ডা. শাম্মী সেখানে ভর্তি হয়ে এনজিওগ্রামের সময় মারা যান। এই ঘটনায় ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা চিকিৎসক সমাজ একটি ব্যাখ্যা দাবি করছি। যে কোনও ঘটনায় কমপ্লিকেশন হতে পারে এবং সেখানে ভুলও হতে পারে কিন্তু সেটা অন্যদিকে ডাইভার্ট করার চেয়ে এই ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন, এখানে ‘হাইড অ্যান্ড সিক’ করার কিছু নেই।’’

 

প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মৌলভীবাজার বিএমএ শাখার সভাপতি ডা. মো.শাব্বির হোসেন খান বলেন, ‘‘ক্যাথল্যাবের জন্য একটি প্রটোকল রয়েছে যেটি সেদিন ল্যাবএইডে মানা হয়নি। আর ডায়াগনোজড এমআইর রোগীর করোনারী এনজিওগ্রাম করতে গিয়ে অ্যানাস্থেটিস্ট, ভেন্টিলেটর, ডিফিব্রিলেটর রাখার দরকার মনে করে না যে কার্ডিওলজিস্ট ‘হি ডেফিনিটলি হ্যাজ সাম ল্যাকিংস। হি মাস্ট টেক দ্য রেসপনসিবিলিটি, অ্যান্ড ফেস দ্যা কো-ইন্সিকোয়েন্সেস। ইটস এ কেইস অফ ডেথ ডিউ টু নেগলিজেন্স, ইরেস্পন্সিবিলিটি অ্যান্ড ইল এফিশিয়েন্সি’’ বলেন ডা. শাব্বির হোসেন খান।

 

এদিকে স্বামীর এমন মৃত্যু মানতেই পারছেন না সোনিয়া হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিকভাবে হয়নি, এই ধকলটা কাটিয়ে কয়েকদিন পরেই ল্যাবএইডের বিরুদ্ধে মামলা করবো আমি,’।

 

পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আনছেন কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনও সন্দেহই নেই যে তাদের অবহেলা রয়েছে। তিনি আরও বলেন,‘এসব হাসপাতালগুলোকে বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত নানা অনিয়মের কারণে লাখ লাখ টাকা জরিমানা করেন, কিন্তু লাখ টাকা জরিমানা দেওয়া এসব হাসপাতালের জন্য কোনও বিষয় না। আমাদের মানুষটা চলে গেল, তাকে আর আমরা ফেরত পাবো না, ডা শাম্মীর স্ত্রী তার স্বামীকে ফেরতে পাবে না-এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’

 

আর এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমি একটি লিখিত বক্তব্য বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) কে দিবো আাগামীকাল শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর)।অনেকে অনেক কথা বলছে আমি শুনতে পাচ্ছি।কিন্তু আমি চুপ করে আছি, কিছু বলছি না।বিএমএ দেখবে, আমিও তাদের ওয়েলকাম করেছি।তারা তদন্ত করুক এবং এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন