তীব্র তাপপ্রবাহ ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

চলতি এপ্রিল মাসের প্রায় পুরোটাজুড়েই বিরাজ করছে আগুনে আবহাওয়া। তাপে গলছে সড়কের পিচ। রোদের তেজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরমের তীব্রতা। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মানুষসহ হাঁসফাঁস করছে প্রাণিকুল। হিটস্ট্রোকে প্রতিদিন মরছে মানুষ। পুড়ছে ফলের বাগান, ফসলের মাঠসহ গাছপালা। চলতি এপ্রিলে গত ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে টানা ২৬ দিন ধরে চলছে দাবদাহ। এ মৌসুমে শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। এদিন বিকাল ৩টায় ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। চলমান দাবদাহে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায়ও তিনজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে তাপমাত্রা কমার কোনো সুখবর দিতে পারেনি আবহাওয়া অধিদপ্তর। সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশের উপর দিয়ে চলমান মৃদু থেকে তীব্র ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত ও জলীয়বাষ্পের আধিক্যে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। এদিকে, সবুজ মেরে কংক্রিটের নগর আর জলাধার ভরাটসহ প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের ফলে অসহনীয় তাপমাত্রা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।

আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানান, চলতি মাসের বাকি দিনগুলোতে তাপপ্রবাহ কমার সম্ভাবনা নেই। এ সময়ে দিনে গরম তো থাকছেই, রাতেও যে তপ্ত বাতাস বয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে। তবে আগামী মাসের শুরুতে বৃষ্টির আভাস রয়েছে।

ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ আদিল খান বলেন, ঢাকার এমন ওয়ার্ড আছে যেখানে ৯০ শতাংশই কংক্রিট। জেলা-উপজেলা পর্যায়েও পুকুর বা জলাধার ভরাট করে পরিকল্পনাহীন ভবন উঠেই চলেছে। নগরগুলোর প্রতিটি ভবন পরিকল্পিত না হলে এবং এলাকাগুলোতে সবুজের ভারসাম্য আনা না হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কঠিন।

গরমে নাভিশ্বাস শহর থেকে গ্রামেও। আদিল খানের ভাষ্যই ওঠে আসে ফরিদপুর সদর উপজেলার চরমাধবদিয়ার সাজেদা বেগমের মুখে। পঞ্চাশোর্ধ সাজেদা বেগম বলেন, তার গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির সামনে ও পেছনে পুকুর ছিল। চৈত্র-বৈশাখের গরমে পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসলে শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যেত। বাড়ির সামনের খাল দিয়ে পালতোলা নৌকা চলত ২৫/৩০ বছর আগেও। চৈত্র মাসেও খালে পানি থাকত। সেই খাল ভরাট করে পাকা বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। এখন আর কোনো বাড়িতে পুকুর নেই। গাছপালা কেটে একটার পর একটা কংক্রিটের ভবন উঠছে। বাতাস শরীরে এসে লাগলে মনে হয় আগুনের হল্কা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। তবে সারাদেশে তাপমাত্রার এমন বৈরী আচরণের জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ঢাকাতেই বছরে অসহনীয় গরম দিনের সংখ্যা গত ছয় দশকে অন্তত তিনগুণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স এই গরম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে বলছে, গত ২৮ বছরে ঢাকা থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটারের সমআয়তনের জলাধার ও ১০ বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ সবুজ কমে গেছে।

কৃষকরা বলছেন, তাপের প্রভাবে কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। জমি থেকে দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে সেচের পানি। ভুট্টা ও পাটসহ নষ্ট হচ্ছে ধান ও সবজির ফলন। আম ও লিচুর গুটিও ঝরে যাচ্ছে। দাবদাহে কৃষি ও কৃষক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

৭৬ বছরের রেকর্ড ভাঙল তাপপ্রবাহ  আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চলতি এপ্রিল মাসে টানা ২৬ দিন তাপপ্রবাহ হয়েছে, যা ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে ১৯৮১ সাল থেকে সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহের উপাত্ত আছে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর আগে ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল, তবে তা টানা ছিল না। কিন্তু এবার টানা ২৬ দিন তাপপ্রবাহ হলো।

আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, এবার টানা তাপপ্রবাহ থাকায় ও বৃষ্টিহীন পরিস্থিতি বিরাজ করায় গরমের অনুভূতি বেড়েছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে অস্বস্তি বেশি হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহীতে রেকর্ড হয়েছে ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলমান দাবদাহ এপ্রিলের বাকিটা জুড়ে চলবে। ঢাকাসহ দাবদাহ চলমান এলাকাগুলোতে তাপমাত্রা আরও বাড়বে। চলমান হিট অ্যালার্ট আজ শনিবার পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, তা বাড়তে পারে মে মাস পর্যন্ত। তবে, মে মাসের প্রথম দিন থেকেই দেশের আকাশে মেঘের উপস্থিতি বাড়বে। গরমের তীব্রতা অনেকটাই কমে আসবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এবারের মতো তাপপ্রবাহ টানা আগে হয়নি। বলা যায়, ৭৬ বছরের রেকর্ড এবার ভেঙে গেল। টানা অন্তত দুই দিন তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে তা তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী বিভাগে গত ১ এপ্রিল থেকে তাপপ্রবাহ শুরু হয়। ১১ এপ্রিল থেকে তাপপ্রবাহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহী, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে তাপপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি।