গোপনে চলছে করোনার অ্যান্টিবডি টেস্ট, উন্মুক্ত করলে ক্ষতির অনেক ঝুঁকি?

করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেশে কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয় কারো কাছেই। এখনো যে ঝুঁকি কাটেনি, সেটি বারবারই পরিষ্কার করে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সংক্রমণ পরিস্থিতি ও প্রকৃত ঝুঁকি নিয়ে যে ধন্দ রয়েছে, সেটি কাটাতে সবচেয়ে বড় উপায় হিসেবে সর্বাত্মক অ্যান্টিবডি টেস্টের দিকে তাকিয়ে আছে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ, এমনকি সাধারণ মানুষও। কিন্তু মানুষের এই আগ্রহের বিষয়ে গরজ এখনো কম সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ে। বরং ক্রমেই ধীরপথে এগোচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারের এমন অবস্থানের মধ্যেই অনেকটা লুকোছাপা ও বিশৃঙ্খলভাবে দেশে চলছে অ্যান্টিবডি টেস্ট; যদিও অ্যান্টিবডি টেস্ট সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। তা ছাড়া এই টেস্টের জন্য কিট আমদানির অনুমোদন এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

তবে সরকারি বা বেসরকারি যেসব হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে, সেখানে ওই প্লাজমা দাতা ও গ্রহীতার সবারই অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশে করোনার অ্যান্টিবডি টেস্টের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জানাচ্ছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। করোনা রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট ছাড়াও গবেষক ও চিকিৎসকদের মধ্যে কিছুসংখ্যক টেস্ট করা হয়েছে, যার সবটাই পরীক্ষামূলক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকারের দিক থেকেও এ ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে চালু করা প্লাজমা সেন্টারে অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। কারণ ওই সেন্টারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত কিট ব্যবহার করায় আবারও আপত্তি তুলেছে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তারা বলছে, অনুমোদনহীন কিট ব্যবহার করলে সেটি কোনোভাবেই বৈধ ও গ্রহণযোগ্য হবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য  বলেন, দুই ধরনের অ্যান্টিবডি টেস্ট হয়। একটি হচ্ছে রক্তের নমুনা দিয়ে অ্যালাইজা পদ্ধতি, যেখানে একসঙ্গে ৯০ থেকে ৯৬টি টেস্ট করা যায়। আরেকটি হচ্ছে বিশেষ কিট দিয়ে র‌্যাপিড টেস্ট। এ ক্ষেত্রে একটি কিট দিয়ে একটি টেস্টই করা যায়। কিন্তু এই দুই পদ্ধতির টেস্টের কোনোটিই ওপেন টু অল (সবার জন্য উন্মুক্ত) করার অনুমোদন নেই বা এটি দেওয়াও হয়নি কোথাও।

ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, অ্যালাইজা পদ্ধতিতে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি টেস্ট করা হয়েছে গত কয়েক মাসে। সবটাই গবেষণার আওতায়। যারা করছে, কিভাবে করছে, তিনি জানেন না। শুধু আইইডিসিআরসহ তিন-চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে কিট আসে কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য। তা ব্যবহার করে কেউ কেউ হয়তো পরীক্ষামূলক টেস্ট করে থাকতে পারে। এ ছাড়া দেশে কোনো অনুমোদিত কিট নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নবনিযুক্ত অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও আইইডিসিআরের (রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের) বর্তমান পরিচালক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা  বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দেশে সবার জন্য বা ডায়াগনসিস পর্যায়ে অ্যান্টিবডি টেস্ট উন্মুক্ত করার মতো সুযোগ নেই। এতে মানুষের উপকারের চেয়ে ক্ষতির ঝুঁকি অনেক বেশি। ভুল রিপোর্ট, মান রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরো বড় বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা থেকেই কেউ এটা করছে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই ছোট পরিসরে এক দফা কমিউনিটিতে অ্যান্টিবডি টেস্ট করেছি সেরো সার্ভেইল্যান্সের আওতায়। শিগগিরই হয়তো এর ফলাফল প্রকাশ করা যাবে। এরপর আরেকটু বড় পরিসরে চালুর প্রক্রিয়া চলছে।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন আহম্মেদ  বলেন, ‘অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। ওই গাইডলাইন অনুসারে সার্ভেইল্যান্স বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আওতায় অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন টেস্ট করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা টেস্ট কিটের অবশ্যই কার্যকারিতার ন্যূনতম মানদণ্ড থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টেস্টের কার্যকারিতা ন্যূনতম ৯০ শতাংশ হতে হবে।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের কার্যকারিতা ৬৯ শতাংশ। ফলে সেটি এসংক্রান্ত কারিগরি কমিটি অনুমোদন করেনি, বরং ওই কার্যকারিতা ন্যূনতম ৯০ শতাংশে ওঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এখন যদি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এটি না করে অনুমোদনহীন কিট ব্যবহার করে, সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। অন্যদিকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে অ্যান্টিজেন টেস্টের কথা বলছিল, সেটি থেকে তারা নিজেরাই সরে গেছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আবার নতুন করে কিছু করছে কি না, সেটি তাঁরা জানেন না।

অন্যদিকে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর  বলেন, ‘অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে আমাদের দেশে কারো কারো মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে। বিশ্বের যে কয়টি দেশে চালু হয়েছে, সেখানে সীমিত পরিসরে সার্ভেইল্যান্সের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও একই প্রক্রিয়ায় সেই কাজ চলছে। আমরা আগামী সপ্তাহে আরো ৫০০ স্যাম্পল সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। অ্যান্টিজেন টেস্টের এখনো কোনো কাজ শুরু করা যায়নি।’

এদিকে প্লাজমা থেরাপি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ খান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে বলেন, প্লাজমা থেরাপির আগে অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে হয়। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির পরিমাপ করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্লাজমাদাতাদের কারো কারো নমুনায় অ্যান্টিবডি কম থাকে। যারা অধিক মাত্রায় আক্রান্ত হয়, যাদের মধ্যে লক্ষণ বা উপসর্গ বেশি থাকে তাদের মধ্যে অ্যান্টিবডিও বেশি থাকে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ