গরীবের বন্ধু ছিলেন রামেক চিকিৎসক হান্নান, শেষ দিনও কেটেছে রোগীদের সেবায়

নিজস্ব প্রতিবেদক:

একসময় টাকার ওভাবে নিজের পড়া-শোনাটায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তার। কিন্তু মনোবল না হারিয়ে নিজের অদম্য ইচ্ছেশক্তি নিয়ে চালিয়ে যান পড়া-শোনায়। এরপর ডাক্তারী পড়া-শোনা শেষে যখন পেশাজীবনে যোগ দেন, তখনোও নানা চোড়ায়-উৎরায় যেতে হয় তাকে। সেখানেও থেমে থাকেননি তিনি। সফলতার সঙ্গে সে ধাপটিও পেরিয়ে হয়ে ওঠেন একজন বিশেষজ্ঞ সার্জন। সহযোগী অধ্যাপ হওয়ার আগেই দ্রুত নাম-জষ ছড়িয়ে পড়ে তার। কিন্তু সেই তিনি কখনই রোগীদের ওপর জোর-জুলুম করে টাকা নিতেন না। বরং নির্দিষ্ট কোনো ফি নিতেন না তিনি। যে রোগী যে পরিমাণ টাকা দিতে সামর্থ ছিল, তার কাছে সেই টাকাই নিতেন তিনি। এমনকি ক্লিনিকে অপারেশন করানোর পরেও তিনি কখনো নির্দিষ্ট ফি নিতেন না। অপারেশনের পরে রোগীদের সামর্থ অনুযায়ী অর্থ নিতেন। এভাবেই মাত্র ৪৬ বছর বয়সেই একজন গরীবের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর সেই তিনি হলেন রামেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল হান্নান। তবে তিনি আর নেই গত শনিবার রাতে একই হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারান আব্দুল হান্নান।

আব্দুল হান্নানের ঘোনিষ্টজন ডেন্টাল চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘তার মতো পরপোকারী চিকিৎসক এই সমাজে খুব কম চোখে পড়ে। তিনি মানবসেবায় নেমে পড়েছিলেন চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তিনি গরীব-অসহায় মানুষের সহায়তায় নিজেই নেমে পড়তেন। অসহায় শিশুদের পাশেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন তিনি। তার মতো একজন গরীবের বন্ধুকে হারিয়ে আমরা হতবিহ্বল।’

নান্নু নামের একজন বলেন, ‘আমার এক পরিচিতজনের অপারেশনের জন্য ১৫ হাজার টাকা ফি দেওয়ার কথা ছিল আব্দুল হান্নানকে। বাইরের ক্লিনিকে অপারেশন করানোর পরে তাকে মাত্র ৮ হাজার টাকা দিয়েছি। তাতেও তিনি না করেননি। বলেছিলেন যা আছে তাই দেন। আমার টাকার জন্য কষ্ট করতে হবে না। প্রয়োজনে টাকা না থাকলে দেওয়া লাগবে না।’

রামেক হাসপাতালের চিকিৎসক অঙ্কুর সেন বলেন, ‘চিকিৎসক হিসেবে স্যার ছিলেন যেমন অসাধারণ, তেমনি মানুষ হিসেবেও ছিলেন অতুলনীয়। আব্দুল হান্নান স্যার সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। তিনি জীবনের শেষটুকুও কাটিয়েছেন রোগীদের চিকিৎসা করেই। যেদিন অসুস্থ পড়েন. সেদিনও তিনি সারাদিন রোগীদের সেবা করেছেন। শেষে বিকেলে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর তাকে ওইদিনই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই দিনটিই ছিল তার জীেবনের শেষ কর্মদিবস। এরকম একজন পরপোকারী মানুষকে হারিয়ে সত্যিই আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।’

এদিকে জানা গেছে,  দেড় মাস আগে টিকা নেওয়ার পরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের এক চিকিৎসকের। ওই চিকিৎসকের নাম আবদুল হান্নান (৪৬)। তিনি রামেকের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। হাসাপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তিনি মারা যান। তবে তিনি ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টেও ভূগছিলেন আগে থেকেই।

অন্যদিকে রাতে হাসপাতালের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাহিদা বেগম (৪৫) নামে আরেক নারীর মৃত্যু হয়। তার বাড়ি নওগাঁ সদরের চক এনায়েতপুর গ্রামে। গত ৪ মার্চ থেকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শনিবার দিবাগত রাত ১টা ৪৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।

রামেক হাসপাতালের আইসিইউ’র ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল চিকিৎসক আব্দুল হান্নানের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, শনিবার দিবাগত রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে ডা. আবদুল হান্নান মারা গেছেন। শুক্রবার রাত থেকে তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।

তিনি আরও জানান, চিকিৎসক আব্দুল হান্নান দেড় মাস আগে করোনার প্রথম টিকা নিয়েছিলেন বলে জানি। তবে প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার পরে তেমন কার্যকরিতা হয় না। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরেই মূলত টিকার কার্যকরিতা শুরু হয়। যার কারণে চিকিৎসক আব্দুল হান্নান টিকা নেওয়ার পরেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।

রামেকের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, ‘গত ২৪ মার্চ চিতিৎসক ডা. আবদুল হান্নানের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই দিন রাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার সারাদিনই তিনি রোগী দেখেছেন। কোন সমস্যা ছিল না। হঠাৎ অসুস্থ হয়েই অবস্থা খারাপ পর্যায়ে চলে যায়। পরীক্ষা করে দেখা যায়, তার ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পরদিন নমুনা পরীক্ষা করে তার করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়।’

ডা. নওশাদ আলী আরও বলেন, ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য আমরা এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে ডা. হান্নানকে ঢাকায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অবস্থা জটিল হওয়ায় এয়ারে নেয়া সম্ভব হয়নি। ডা. হান্নানকে গুরুতর অবস্থায় আইসিইউতেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচানো যায়নি।’

এদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় চিকিৎক আব্দুল হান্নানের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসক কর্মচারীরা উপস্থিত হয়ে শেষ বিদায় দেন প্রিয় চিকিৎসক আব্দুল হান্নানকে।

স/আর