গরমে দুর্বিষহ ট্রেনযাত্রা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে গতকাল শনিবার বিকেল পৌনে ৪টায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ছিল চারটি ট্রেন। এর মধ্যে যমুনা এক্সপ্রেসের একটু পরই ছেড়ে যাওয়ার কথা জামালপুরের তারাকান্দির উদ্দেশে। ট্রেনের ১৩টি বগিই মানুষে ঠাসা। ৬১১১ নম্বর বগিতে ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে অসুস্থ স্ত্রী মাহফুজাকে নিয়ে বসে আছেন আবদুর রাজ্জাক। তীব্র গরমে মাহফুজার গলা শুকিয়ে কাঠ। কোনো রকমে দুই চোখ মেলে তাকান তিনি। কোনো আসন তাঁরা পাননি। বাথরুমের পাশে এক চিলতে জায়গায় চাটাই বিছিয়ে দিয়েছে অন্যরা। স্বামী চার লিটার পানি এনে রেখেছেন, তাও তপ্ত হয়ে উঠেছে। হাতপাখা দিয়ে স্ত্রীর গায়ে বাতাস করতে করতে আবদুর রাজ্জাক জানান, মাহফুজা ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ১০ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। ঈদ সামনে থাকায় বাড়ি যাচ্ছেন। রাজ্জাক জিজ্ঞেস করেন, ‘কখন ছাড়বে ট্রেন?’

একই ট্রেনে মাহফুজার কাছে বসেছিলেন মো. মাহবুব হোসেন। জানালা দিয়ে আসা কড়া রোদ ঢেকে রেখেছিলেন সংবাদপত্র টেনে। মাহবুব মত্স্য অধিদপ্তরের অফিস সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছেন দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত দনিয়া কলেজ কেন্দ্রে। ট্রেনে উঠেছেন ময়মনসিংহে যাওয়ার জন্য। সেখান থেকে বাসে যাবেন নেত্রকোনা। আগের রাতে নেত্রকোনা থেকে হাওর এক্সপ্রেসে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু ওই ট্রেনে যাওয়ার কোনো টিকিট পাননি। মাহবুব বলেন, ‘আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী, তার পরও টিকিট পেলাম না।’

রাজধানী থেকে প্রতিদিন ৩১টি আন্ত নগরসহ বিভিন্ন ধরনের ৫৩টি ট্রেন চলাচল করে। পর্যাপ্ত বগি না থাকা, টিকিট না থাকা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগি না থাকায় দুর্ভোগে পড়ছে যাত্রীরা। তীব্র গরমে তাদের এখন ট্রেনে দুর্ভোগ বেড়েছে। শিশু ও নারীদের কষ্ট আরো বেশি।

কয়েক দিন ধরেই গরমে পুড়ছে দেশ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গতকাল দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সিলেট থেকে ঢাকামুখী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীরা গতকাল দুপুরে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে ক্ষোভ ঝাড়ে রেল কর্তৃপক্ষের ওপর। ওই ট্রেনে আগে ১৭টি বগি ছিল। এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে ৯টি। তার মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগি নেই একটিও। ওই ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী শরীফ হোসেন জানান, সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে শায়েস্তাগঞ্জ থেকে উঠেছিলেন। শাহজীবাজার পার হওয়ার পর ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে ট্রেনটি। আজমপুর আসার আগে দাঁড়িয়ে থাকে ১৫ মিনিট। এর পর থেকে ট্রেনের গতি কমতেই থাকে। ভৈরব স্টেশনে আসার আগে আউটারে দাঁড়িয়ে ছিল ১০ মিনিট। টঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকে ২৫ মিনিট। বিমানবন্দর রেলস্টেশনে আসার আগে আউটারে পাঁচ মিনিট দাঁড়ায়। তেজগাঁওয়ে হঠাৎ ২২ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। ওই সময় তীব্র গরমে ট্রেনজুড়ে ছোট শিশুরা চিৎকার করতে থাকে। মা-বাবারা তাদের কোলে নিয়ে পায়চারি করতে থাকেন। কেউ হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেন। তার পরও বাচ্চাদের কান্না থামছিল না। তাদেরই একজন অরিজিৎ জানান, প্রচণ্ড গরমে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে কয়েকজন যাত্রী। তবে যাদের সঙ্গে নারী ও শিশু ছিল তারা বড় বিপদে ছিল। তিনি বলেন, ‘আগে এই ট্রেনে এসি কেবিন ছিল, এখন নেই। এটা দুঃখজনক। কেন ট্রেনের বগি কমে গেল, এত গরমে কেন এসি কম্পার্টমেন্ট নেই বুঝতে পারি না। সিগন্যালের নামে যত্রতত্র ট্রেন থামিয়ে রাখা হয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের ভোগান্তি বেশি হচ্ছিল।’ তিনি আরো বলেন, বিষফোড়ার মতো আছে ছিনতাই। ছাদে উঠে জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে যাত্রীদের ছোট ব্যাগ, মোবাইল ফোন টান দিয়ে নিয়ে যায়। ট্রেনের গার্ড থাকে নিষ্ক্রিয়। এসব সমস্যা সমাধান না করলে ঈদ যাত্রায় মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।

গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সুবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর প্রভাতী, একতা, তিস্তা, পারাবত, উপকূল, অগ্নিবীণা, সিল্কসিটি, রংপুর এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ট্রেনের যাত্রীরা অভিযোগ করে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগি কম থাকায় তাদের গরমে সিদ্ধ হতে হয়েছে ট্রেনে।

এ বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক সীতাংশু চক্রবর্ত্তী  বলেন, সব ট্রেনের সব বগি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ সক্ষমতা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নেই। তবে ঈদের বিশেষ ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগি বেশি আছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন  বলেন, ‘বছরের সব সময়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরার চাহিদা যে পথে বেশি থাকে, সেখানে চাহিদা অনুসারে তা দেওয়ার চেষ্টা আমরা করি। যেমন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুটি বগি ছিল এ সুবিধার, পরে দেখা গেল একটি প্রায় খালিই থাকে। আমরা ঢাকা-কক্সবাজার পথে পর্যটক ট্রেন চালু করব। এ জন্য জরিপ করে দেখেছি যাত্রীদের ৬০ শতাংশই নন-এসি বগি চায়।’