খেলাপি ঋণ আদায় ও সুদহার হ্রাস যেভাবে হবে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়মিত সভায় জানানো হয়, নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমানো সম্ভব হয়নি।

ব্যাংকগুলোকে স্বীয় ঘোষণা অনুযায়ী ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ে তদারকি জোরদার করার নির্দেশনাও দেয়া হয়।

সভায় এ মর্মে তথ্য প্রকাশ করা হয় যে, বারবার তাগিদ দেয়া এবং বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা একাধিকবার অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও ঋণের সুদের হার এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসেনি। রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ৫৯টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টি ব্যাংকের সুদের হার এখনও ডাবল ডিজিটে রয়েছে। কোনো কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক ১৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আরোপ করছে।

গত এক বছর ধরে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনার জন্য নানা পর্যায় থেকে নির্দেশনা প্রদান করা সত্ত্বেও ব্যাংক মালিকরা সুদের হার এখনও যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনেননি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার ব্যাংক মালিকদের সুদের হার কমিয়ে আনার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

অথচ বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করে নানা ধরনের সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহের অনুমতি নিয়েছেন। একই সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৫০ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণের জন্যও বিধান করিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে। আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ২৫ শতাংশ আমানত বেসরকারি ব্যাংকে সংরক্ষণ করা যেত।

বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের দাবির মুখে অ্যাডভান্স-ডিপোজিট রেশিও (এডি রেশিও) কমানো হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে একই পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে ৪ জন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়েছে। পরিচালকদের মেয়াদকাল অব্যাহতভাবে দুই টার্মের (প্রতি টার্ম তিন বছর) পরিবর্তে তিন টার্ম তথা ৯ বছর করা হয়েছে।

এত কিছু সুবিধা আদায় করে নেয়ার পরও বেসরকারি খাতের ব্যাংক মালিকরা তাদের অঙ্গীকার মতো ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমায়নি। গত একবছর ধরে তারা শুধু সুদের হার কমানোর আশ্বাসই দিয়েছে, অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করেনি।

বেসরকারি খাতের ব্যাংক মালিকরা বারবার অঙ্গীকার করেও কেন সুদের হার কমাচ্ছেন না বা কমাতে পারছেন না? ব্যাংক ঋণের সুদের হার কেন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হ্রাস পাচ্ছে না, তার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ব্যাংকগুলো আগে প্রদত্ত ঋণ, যার বেশিরভাগই খেলাপি হয়ে পড়েছে তা আদায় করার ক্ষেত্রে সামান্যতম সাফল্য দেখাতে পারছে না। ফলে চাইলেও তারা ঋণের সুদের হার কমাতে পারছে না।

এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দেয়ার পরও তারা সেই পরামর্শের প্রতি সম্মান দেখাতে পারছেন না। নতুন অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর এক অনুষ্ঠানে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আর এক টাকাও বাড়বে না। তার এ কথায় সবাই আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, মার্চ ২০১৯ কোয়ার্টারে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

এটা প্রদত্ত ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ যোগ করলে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে, যা ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মাঝে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।

মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ হিসাব অবলোপনের নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়। আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দ বা লোকসান হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে ওই ঋণ হিসাবের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ এবং উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরের পর তা অবলোপন করা যেত। সংশোধিত নতুন আইনে একটি ঋণ হিসাব মন্দ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর ৩ বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যাবে।

এ জন্য আদালতে মামলা দায়ের এবং শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান শিথিল করা হয়েছে। ফলে আগামীতে ঋণ হিসাব অবলোপনের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে। যেহেতু অবলোপনকৃত ঋণকে খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয় না।

‘অবলোপন’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে মওকুফ করে দেয়া বা পাওনা ঋণের দাবি ত্যাগ করার মতো একটি আবহ সৃষ্টি হয়; কিন্তু অবলোপন অর্থ কোনোভাবেই পাওনা ঋণের দাবি ত্যাগ করা নয়। শুধু এই ঋণকে ব্যাংকের মূল লেজার থেকে আলাদা করে রাখা হয়।

অনেকটা সেই পিতার মতো, যার তিন ছেলের মধ্যে দু’জন সুস্থ-স্বাভাবিক এবং তৃতীয়জন শারীরিক প্রতিবন্ধী। কোনো আত্মীয়স্বজন বাড়িতে বেড়াতে এলে তিনি সুস্থ দুই সন্তানকে তাদের কাছে উপস্থিত করে পরিচয় করিয়ে দেন। তৃতীয় সন্তানকে লোক লজ্জার ভয়ে বাড়ির ভেতরে আটকে রাখেন। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, তৃতীয় সন্তানটি অস্তিত্ববিহীন হয়ে যায়। বা তার প্রতি অভিভাবকের কোনো দায়িত্ব থাকে না।

তৃতীয় সন্তানটি অস্তিত্ববান কিন্তু দৃশ্যমান নয়। অবলোপনকৃত ঋণও ঠিক সেই রকম, যা অস্তিত্ববান কিন্তু প্রদর্শিত নয়। দ্বিতীয় যে আইনি সংস্কার করা হয়েছে তা হল ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ নীতিমালা সহজীকরণ করা।

আগে কোনো ঋণ হিসাব খেলাপি হয়ে পড়লে বিশেষ শর্তাধীনে মোট পাওনা ঋণের ১০ শতাংশ অথবা মোট খেলাপি ঋণের ১৫ শতাংশ এককালীন ব্যাংকে জমা দিয়ে তিন বছরের জন্য ঋণ হিসাবটি পুনঃতফসিলিকরণ করিয়ে নেয়া যেত।

সংশোধিত নতুন আইনে এককালীন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণ করিয়ে নেয়া যাবে। পুনঃতফসিলীকরণকৃত ঋণ হিসাবের ওপর আরোপিত সুদহার হবে ৯ শতাংশ।

অথচ যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তাদের সুদের হার ১১/১২ শতাংশ বা তারও বেশি। বলা হয়েছে, যারা নানা প্রতিকূলতার কারণে ঋণের কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছেন না তাদের এ বিশেষ সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং আইনে প্রকৃত ঋণখেলাপি এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারিত নেই। ফলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরাই এসব সুবিধা ভোগ করে থাকেন। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে বলে মনে হয় না।

এ সংশোধিত আইন দুটি কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। কিন্তু এতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না বরং আগামীতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

অনেকের মনেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য কতটা ক্ষতিকর? খেলাপি ঋণ বলতে আমরা বুঝি এমন একটি অবস্থা, যেখানে একজন উদ্যোক্তা বা ঋণ গ্রহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকালে সেই ঋণ কীভাবে পরিশোধ করবেন তার অঙ্গীকার বিবৃত থাকে। ব্যাংক তার নিজের অর্থে ব্যবসা করে না। ব্যাংক নির্ধারিত হারে সুদ প্রদানের শর্তে সাধারণ আমানতকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।

সেই অর্থ আমানতকারীদের প্রদেয় সুদহারের চেয়ে বেশি পরিমাণ সুদ ধার্য করে ঋণগ্রহীতাদের প্রদান করে। ঋণ গ্রহণকারী নির্ধারিত সময়ে সুদসহ কিস্তি ফেরত না দিলে ব্যাংক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ ব্যাংক সম্ভাব্য মুনাফা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু তাই নয়, ব্যাংক ঋণের কিস্তি আদায় করতে না পারলেও আমানতকারীকে ঠিকই নির্ধারিত হারে সুদ প্রদান করতে হয়। ঋণের কিস্তি আদায় না হলে ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং নতুন ঋণদান কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়।

যে খেলাপি ঋণ আটকে থাকে তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। কারণ যে কোনো সময় আমানতকারী তার টাকা ফেরত চাইলে ব্যাংক সেই টাকা প্রদানে বাধ্য। বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে আছে।

এর মধ্যে মন্দ ঋণের পরিমাণ যদি এক লাখ কোটি টাকা হয় তাহলে ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা ২ লাখ কোটি টাকা হ্রাস পাবে। কারণ ১ লাখ কোটি টাকা গ্রাহকের কাছে আটকে থাকার ফলে তা নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারবে না। উপরন্তু সেই ১ লাখ কোটি টাকার বিপরীতে আরও ১ লাখ কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে হবে।

প্রত্যেকটি দেশেই দু’ধরনের ঋণখেলাপি দেখা যায়। এদের মধ্যে একটি শ্রেণি আছেন, যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা বিরূপ অবস্থার কারণে সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। এরা প্রকৃত ঋণখেলাপি। এদের ঋণ পরিশোধে সামর্থ্যবান করে তোলা গেলে তারা ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবেন। আর একটি শ্রেণির ঋণখেলাপি আছেন যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেন ফেরত না দেয়ার উদ্দেশ্যেই।

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেন না। অনেকেই এক কাজের জন্য ঋণ গ্রহণ করে তা অন্য কাজে ব্যবহার করেন। বিদেশে পাচার করেন। একজন ঋণগ্রহীতা যখন ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করেন ব্যাংক ম্যানেজার ঠিকই চিনতে পারেন ভবিষ্যতে তিনি ঋণের টাকা ফেরত দেবেন কিনা।

ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে আইন প্রচলিত আছে তা অত্যন্ত কঠিন এবং সহজেই সেই আইন ফাঁকি দিয়ে কারও পক্ষে ঋণ গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ব্যাংক ম্যানেজার ও অন্যান্য কর্মকর্তা নানা কারণে তাদের সহায়তা করে থাকেন।

একজন ব্যাংক কর্মকর্তা যদি শতভাগ সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন তাহলে খেলাপি ঋণ সৃষ্টির সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে। দুটি কাজ করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমতে পারে। প্রথমত, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার মতো দুঃসাহস দেখাতে না পারে। দ্বিতীয়ত, ঋণদানকালে সর্বোচ্চ সততা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে প্রস্তাবিত ঋণ আবেদনপত্র মূল্যায়ন করতে হবে, যাতে এমন কেউ ঋণ গ্রহণ করতে না পারেন, যিনি ভবিষ্যতে খেলাপি হবেন।

ঋণদানকালে যদি বন্ধকি সম্পদ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। মনে রাখতে হবে, বাঁধের উজানে কেউ যদি পানি ঘোলা করে তাহলে ভাটিতে ঘোলা পানিই প্রবাহিত হবে। কাজেই কেউ যাতে উজানে পানি ঘোলা করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

এম এ খালেক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক