কেউ এগিয়ে এল না, কিন্তু কেন?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রিফাতের হত্যাকাণ্ড জাতিকে নাড়া দিয়েছে। এখানে জাতি বলতে আমি যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়, সেই জাতিকে বোঝাচ্ছি। এই সক্রিয় ব্যক্তিরা সমগ্র জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করেন কি না, বলতে পারব না। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জাতি এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডে বিচলিত। যাঁরা এই মাধ্যমে সক্রিয় নন, তাঁরাও পত্রপত্রিকায় খবর পড়ে ও চ্যানেলগুলোর সংবাদ দেখে একইভাবে বিচলিত। যেমন এই অধম। কারণ, আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই।

সহকর্মীরা মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে তোলপাড়গুলো হয়, সেগুলো সম্পর্কে অবহিত করেন। রিফাত হত্যাকাণ্ডে তাঁকে বাঁচাতে কেউ কেন এগিয়ে এল না, সে নিয়ে অগণিত মতামতের আদান-প্রদান হচ্ছে। এখন ‘ফেসবুক জেনারেশন’; সবাই আত্মকেন্দ্রিক আর লাইক-ডিসলাইক নিয়ে মশগুল। সামাজিক বন্ধন ঢিলে হয়ে গেছে। নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্নতি ছাড়া সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা বলে যে ব্যাপারটি ছিল, সেটা এখন বিলীন হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই শুধু নিজেকে নিয়েই মশগুল। তারপর আছে নৈতিক অধঃপতনের বয়ান। আমাদের নীতিনৈতিকতা গোল্লায় গেছে। নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে, অর্থাৎ, আমাদের অনেকেই এখন খারাপ হয়ে গেছি। আবার ভালো হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব বিশ্লেষণ থেকে অধমের ধারণা জন্মেছে যে দেশে ফেসবুকের ব্যবহার কমলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উৎপাত হ্রাস পেলে, প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁদের স্ব–স্ব প্রবৃদ্ধির লম্ফঝম্ফ কিছুটা কমিয়ে পাড়া–প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সুখ–দুঃখের ব্যাপারে কিছু মনোযোগী হলে আর আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের নীতিনৈতিকতার প্রসার ঘটাতে পারলে ভবিষ্যতে যদি রিফাতের হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে বোধ হয় লোকজন এগিয়ে আসবে।

২.

অবশ্য লেখক আনিসুল হক তাঁর ২৮ জুন ২০১৯–এর প্রথম আলোর মতামত পৃষ্ঠায় ‘নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কী বিচার চাইব’ শিরোনামে অধ্যাপক আলী রীয়াজের ‘ভয়ের সংস্কৃতি’র বিশ্লেষণের কথা উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক আলী রীয়াজের ধারণা যে ভয়ের সংস্কৃতি সম্মিলিত উদ্যোগের ধারণা লুপ্ত
করে দেয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমরা অনেকেই ভয়ে থাকি। ভয়টা এই জন্য না যে অপরাধ করেছি বা অপরাধের প্রস্তুতি নিচ্ছি। কী বলতে কী বলে ফেলি (বা লিখে ফেলি), সেটাই ভয়ের কারণ। অবশ্য সজোরে সরকারের তৈলমর্দনে ঝাঁপিয়ে পড়লে হয়তো ভয় থেকে মুক্তি মিলত। কিন্তু সেই পথে পিপাভর্তি খাঁটি তেল নিয়ে অনেকেই অনেক দূর এগিয়ে আছেন।

৩.

কেউ কেন এগিয়ে এল না, তার নিঃসন্দেহে অনেক কারণ থাকতে পারে। জটিল কোনো সামাজিক সমস্যার মূলে একটিমাত্র নির্দিষ্ট কারণ দিয়ে ঘটনাটির ব্যাখ্যা চলে না। তবে অনেক কারণের মধ্যে একটি বা দুইি প্রধান কারণ থাকতে পারে।

কেউ এগিয়ে আসেনি তার কারণ হলো, আমরা ২০০২ সালের শেষের দিক থেকে হত্যাকাণ্ডে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। হত্যাকাণ্ড একটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে পড়েছে। সরকার ঘোষণা দিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। বছরখানেকের কিছু বেশি হলো সরকার ঘোষণা দিয়ে মাদক নির্মূলে নেমেছে, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল মানুষ নিহত হওয়া। এমনকি মাদক কারবারিরাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে বন্দুক-পিস্তল নিয়ে গোলাগুলি করে একে অপরকে খুন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। টেকনাফের একরামুল্লাহর আর্তচিৎকার আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। তাতে হয়েছেটা কী? কেউ কি গ্রেপ্তার হয়েছে? এ ধরনের মৃত্যু এখন স্বাভাবিক।

প্রতি সপ্তাহে পত্রপত্রিকায় সম্ভবত দু–তিনবার ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ শিরোনামে খবর আমরা পড়ি। গুলি খেয়ে মানুষ মরছে। আমরা মোটেও বিচলিত হই না। বরং এখনো অনেকেই ভাবে যে এই রকম মারাটা ভালো। বড় ধরনের অপরাধের পর আজকাল তো টেলিভিশনের পর্দায় মাঝেমধ্যে স্লোগানও শুনেছি—ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। অর্থাৎ, মৃত্যু চাই।

ফ্রান্সে এখন তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়েছে। তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে গরম দিন। আমাদের ঢাকা শহরে খুব বেশি হলে তাপমাত্রা উঠে ৩৫-৩৮ ডিগ্রি। ধরুন, সামনের সপ্তাহে তাপমাত্রা উঠে গেল ৪৫ ডিগ্রিতে। আমরা সবাই হাপিত্যেশ করব, হাঁসফাঁস করব, গরমে সবার অবস্থা হবে ত্রাহি ত্রাহি। সরকারের মুণ্ডুপাত অবশ্যই করব, সবাই মিলে। এই অস্বাভাবিক গরমে জান কেমন করে বাঁচাব, কী করা যেতে পারে, সেটা থাকবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের টপ আইটেম। ধরুন, আগামী বছর অর্থাৎ, আগামী বছর একই অবস্থায়, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে তাপমাত্রা আবার ৪৫ ডিগ্রি, এভাবে চলল ২০২১ ও ২০২২ সালেও। ২০২৩ সালেও যদি আবার তাপমাত্রা ৪৫-৪৭ ডিগ্রি হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এবং নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে এই বছরের তুলনায় তাপমাত্রা নিয়ে হুলুস্থুল ২০২৩ সালে হবে অনেক, অনেক কম। কারণ, তত দিনে আমরা এই তাপমাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাব। ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা তখন হয়ে পড়বে স্বাভাবিক।

৪.

উচ্চ তাপমাত্রার মতো এত দিনে মানুষ মারাটাও এখন হয়ে যাচ্ছে প্রায় স্বাভাবিক। নির্বাচন অস্বাভাবিক হলে আগে হুলুস্থুল হতো, প্রতিবাদ হতো। প্রতিকারের খোঁজে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠত। এখন ২০১৪ থেকে অস্বাভাবিক নির্বাচন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ভোররাতের নির্বাচন, গত কয়েক মাসে প্রতিদ্বন্দ্বী ও ভোটারবিহীন স্থানীয় সরকার নির্বাচনও এখন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাই রিফাতকে বাঁচানোর মতো যেমন কেউ এগিয়ে আসেনি, তেমনি নির্বাচনের ব্যাপারেও আমরা সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছি। এই রকম নির্বাচনই এখন বাংলাদেশের জন্য স্বাভাবিক।

যখন থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল, প্রায় তখন থেকেই বলছি, বারবার বলছি—মানুষ মেরে অপরাধ সমস্যার সমাধান হয় না। বহু দশক ধরে যে আইন আর বিচারব্যবস্থা তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল, সেটাকে পাশ কাটিয়ে মানুষ মেরে সমস্যার সমাধান হবে না। বহু সমাজ, বিশেষত গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারী বহু সমাজ গত ৫০ বছরে এই পথে হেঁটেছে। মানুষ মেরে কেউ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।

যখন সরকার মানুষ মারে, মানুষ মারার প্রশ্রয় দেয়, তখন ধীরে ধীরে সমাজ আর সমাজ থাকে না। বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতা সমাজকে ছেয়ে ফেলে। ভয়-ত্রাস তো আছেই। সবাই গা বাঁচিয়ে চলার একটা অদ্ভুত অপসংস্কৃতিতে নিজেকে ঢেকে ফেলে। বিপদে–আপদে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। এটা ফেসবুকের দোষ না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র যখন নীতিনৈতিকতা ধ্বংস করে, তখন সমাজের সদস্যদের মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়। রাষ্ট্র আমাদের মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাই রিফাতকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। আর যাদের হাতে অস্ত্র
আছে, তাদের নিবৃত্ত করা অস্ত্রহীন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। রাষ্ট্র অপরাধ দমনের নামে মানুষ মারা বন্ধ না করলে আর গণতন্ত্রের নামে অস্বাভাবিক নির্বাচনকে স্বাভাবিক বলে চালিয়ে যেতে থাকলে আমাদের সামনে আরও ভয়ংকর দিন আসবে।