হোলি আর্টিজানে হামলা: আন্তর্জাতিক জঙ্গি তৎপরতারই অংশ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

এ বছরের ১ ও ২ জুলাই বাংলাদেশ তার ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস জঙ্গি হামলার তৃতীয়বার্ষিকী পালন করছে। তিন বছর আগে চাপাতি ও রাইফেল সজ্জিত পাঁচজন জঙ্গি হোলি আর্টিজান বেকারি ক্যাফেতে ঢুকে নৃশংস তাণ্ডব চালিয়েছিল। তারা ২২ জনকে (যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বিদেশি) প্রথমে জিম্মি করেছিল এবং ১২ ঘণ্টা পর সবাইকে হত্যা করেছিল।

ওই সময় বহু পর্যবেক্ষক মনে করেছেন যে, বাংলাদেশে তখন ধারাবাহিকভাবে বিদেশি নাগরিক, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং মৌলবাদবিরোধী উচ্চকিত ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীরা যে সিরিজ হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল, তারই ধারাবাহিকতায় হোলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটেছে। এবং সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই এ ঘটনা বিশ্লেষণ করতে হবে। ২০০৩ ও ২০০৬ সালের মধ্যবর্তী সময়টাতে এই ধরনের হামলার তীব্রতা তুঙ্গে পৌঁছেছিল।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস হোলি আর্টিজান হামলার দায় স্বীকার করেছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার বরাবরই এই হামলায় কোনো বিদেশি শক্তির হাত থাকার কথা অস্বীকার করে এসেছে। সরকার বলে এসেছে, এর পেছনে শুধু স্থানীয় জেএমবির হাত রয়েছে। সরকারের এই অবস্থান দেশে ও বিদেশে তখন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জিহাদি মতবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিপদ ঠেকাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে যখন ব্যাপকভিত্তিক উন্মুক্ত আলোচনা দরকার ছিল, তখন সরকার সেদিকে না গিয়ে কঠোরভাবে সন্ত্রাস দমন অভিযানে নেমে পড়ল। রাজনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় বিভাজিত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সমাজ তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিধ্বংসী অভিযান ঠিক কি ঠিক না, তা নিয়েই তর্কে জড়িয়ে পড়ল। জিহাদের নামে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া শক্তিকে প্রতিহত করার বিষয়ে পক্ষপাতহীন মতবিনিময়কে সমর্থন দেওয়ার বদলে কিছু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই সহিংস পন্থাকে সমর্থন দিল।

পরিতাপের বিষয়, হোলি আর্টিজানের এই ঘটনা বাংলাদেশের সন্ত্রাসের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় উন্মুক্ত করেছে। এটি সহজেই অনুমান করা যায়, এই হামলাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। ‘স্থানীয়ভাবে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসীরা’ স্থানিক ভাবনা থেকে এই হামলা চালিয়েছে—ব্যাপারটি মোটেও সে রকম নয়, বরং এটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক জঙ্গি তৎপরতারই অংশ।

সরকারের আনুষ্ঠানিক ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ও দেশে বড় হয়ে ওঠা অপরাধীরাই এই অপরাধ করেছে। এই ভাষ্যের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। বাংলাদেশের নামের সঙ্গে ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসীদের আখড়া’ তকমা জুড়ে যাওয়া এবং চরমভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই কর্মকর্তারা এই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর যোগসাজশ থাকার কথা নাকচ করে থাকতে পারেন। হামলাকারীদের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের ভাবমূর্তি ম্লান করা এবং দেশের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ানো। কিন্তু হামলার বিষয়ে দেওয়া সরকারি ভাষ্য বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।

সরকারের ভাষ্য শুনে অনেকের মনে হতে পারে এ হামলায় খুব বড় কোনো সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত ছিল না। মনে হতে পারে, একেবারেই স্থানীয় পর্যায়ের সন্ত্রাসীরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। হোলি আর্টিজানকে ‘স্থানীয়’ তকমায় সীমাবদ্ধ করে রাখার মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের অনলাইনভিত্তিক ক্রমবর্ধমান যোগাযোগের বিষয়টিকে একধরনের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রবিরোধী চেতনা বিস্তারের জন্য উগ্রপন্থী মতবাদ দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে নিরন্তর প্রচার করা হচ্ছে।

 আমাদের অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে, অসংখ্য দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেসব সন্ত্রাসী তৎপরতার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, হোলি আর্টিজান হামলা তার বাইরের কিছু নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এই হামলাটি স্থানীয় জঙ্গিরা চালিয়েছে এবং পুরো ঘটনাটি সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই ঘটেছে। অন্যভাবে বলা যায়, ইতিপূর্বে বাংলাদেশে যতগুলো জঙ্গি হামলা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে এই হামলার বহু মিল আছে এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি গ্রুপগুলো বা ‘গ্লোবাল জিহাদ’ এর মধ্যে সরাসরি ভূমিকা রাখেনি। কিন্তু বাংলাদেশের আগের অন্য সবগুলো জঙ্গি হামলার সঙ্গে এই হামলার তুলনা করলে দেখা যাবে এটি বাংলাদেশের হামলার ধরনে নতুন মোড় এনেছে এবং এর ধরনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হামলার ধরনের মিল আছে।

একইভাবে এ বছরের শুরুতে শ্রীলঙ্কায় গির্জায় যে হামলা হলো, সেটি দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসী তৎপরতার ক্ষেত্রে নতুন ‘সন্ধিক্ষণের’ সূচনা করেছে। শ্রীলঙ্কার হামলা প্রমাণ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে আইএসের প্রভাব বাড়ছে। সিরিয়া ও ইরাকে আইএস সামরিকভাবে পরাজিত হওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়ে তাদের আগ্রহ বেড়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার ‘স্থানীয় জঙ্গিরা’ শুধু যে আইএসের মতাদর্শের দিকে ক্ষিপ্র গতিতে ধাবিত হচ্ছে, তা-ই নয়, তারা আইএসের সাংগঠনিক কায়দাকানুন দ্রুত রপ্ত করে ফেলছে।

দক্ষিণ এশিয়ার সন্ত্রাসী হামলার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। এখানকার সন্ত্রাসীরা ‘বৈশ্বিক জিহাদ’–এর নৃশংসতা ও তাদের জটিলভাবে সমন্বয়সাধন করার কৌশল অনুসরণ করা শুরু করেছে। এসব স্থানীয় সন্ত্রাসী এখন দেশের ভেতর এবং বাইরের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার জঙ্গি তৎপরতায় একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর তদন্ত কর্মকর্তাদের ওপরও যাতে হামলা করা যায়, সে জন্য হামলার মূল পরিকল্পকেরা তাদের পরিবারের সব সদস্যকে আত্মঘাতী হামলাকারীতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতায়ও নতুন একটি ধারা যুক্ত হয়েছে, যেখানে সন্ত্রাসীরা তাদের স্বামী বা স্ত্রীকে সরাসরি জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে ফেলছে।

ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দক্ষিণ–পূর্ব এশীয় দেশগুলোতেও জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গেছে। এসব দেশের সরকারগুলোকে শুধু (ধর্মীয় মতবাদভিত্তিক) সহিংস আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তা নয়, ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদকেও তাদের সামাল দিতে হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোর মধ্যে অনেকগুলো সাধারণ মিল পাওয়া যাচ্ছে। এসব দেশের স্থানীয় জঙ্গিরা স্থানীয় সমস্যা বা বঞ্চনার শিকার। এসব স্থানীয় গ্রুপের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়ছে। সমভাবাপন্ন এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে। এতে উভয় পক্ষই লাভবান হচ্ছে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে প্রশিক্ষণ, অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে এবং আইএস কিংবা আল–কায়েদার মতো বৈশ্বিক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথ বাতলে দিচ্ছে।

আর এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গ্রুপগুলো নিজেদের অ্যাজেন্ডা ও প্রপাগান্ডার স্বার্থে স্থানীয় সংঘাত ও হামলার ‘কৃতিত্ব’ ‘হাইজ্যাক’ করতে সমর্থ হচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের সমর্থক ও ‘রিক্রুটিং ঘাঁটি’র পরিধি বিস্তৃত করতে সক্ষম হচ্ছে। ২০১৭ সালে ফিলিপাইনের স্থানীয় আইএস ‘অ্যাফিলিয়েট’রা দেশটির মারাওয়ি শহরের পুরোটাই কিছু সময়ের জন্য হলেও নিজেদের দখলে নিতে পেরেছিল। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের মদদ পেলে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা কতটা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা ওই সময় স্পষ্ট হয়েছে।

শেষ কথা
জঙ্গি হামলায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগসাজশ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ অবস্থায় তাদের প্রতিহত করা ভিন্ন ভিন্ন দেশের একক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। একেকটি অঞ্চলের কয়েকটি দেশের সরকার ও সরকারি সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি আঞ্চলিক পর্যায়ের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলনীতি অনুসরণ করে এগোনো দরকার। সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে টানা অভিযান চালানোর কারণে বাংলাদেশে গত বছর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার সংখ্যা কমে এলেও এটি আসলে একধরনের কৃত্রিম শান্ত অবস্থা। সন্ত্রাসী হুমকির আন্তর্জাতিক মাত্রাকে খাটো করে দেখা এবং সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতাকে গভীরভাবে রাজনীতিকরণ ভয়ানক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

অবস্থা বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, হোলি আর্টিজানে ভয়ংকর হামলার তিন বছর পরও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী নেতারা বুঝতে চাননি কিংবা বুঝতে পারেননি যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাভের তুলনায় ‘গ্লোবাল জিহাদের’ পূর্ণমাত্রাকে উপেক্ষা করার দাম অনেক বেশি। এটি বাংলাদেশকে আবার মৌলবাদী ভাবাদর্শের মধ্যে আটকে ফেলতে পারে।