কৃষি বিভাগের উদাশীনতায় ঠেকানো যাচ্ছে না শিমের পচন রোগ

কাজী কামাল হোসেন,নওগাঁ:
অনাবৃষ্টি ও ভ্যাপসা গরমে নওগাঁয় শিমে পচন রোগ দেয়ায় জেলার হাজার হাজার কৃষকদের লাগানো আগাম শিমের কাঙ্খিত ফসল পাচ্ছেন না। এ কারণে এখন পর্যন্ত জেলার অধিকাংশ শিম চাষিরা সিম বিক্রি করতে পারেননি। এতে চলতি বছর লোকসানের আশঙ্কা করছেন শিমচাষিরা। এদিকে স্থানীয়ভাবে পাইকারি বাজার না থাকায় এর ফায়দা লুটছেন ফরিয়া ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়াও কৃষি বিভাগের সহযোগিতা না পাওয়া রয়েছে অভিযোগ শিম চাষিদের।

জানা গেছে, নওগাঁয় প্রায় পাঁচ হাজার বিঘা জমিতে শিম চাষ করা হয়েছে। জেলার মধ্যে সদর উপজেলার বর্ষাইল, বক্তারপুর, কীর্ত্তিপুর ইউনিয়ন সবজি চাষের জন্যে উপযোগি হওয়ায় ইউনিয়নের অধিকাংশ জমিতেই শিম, লাউ, চমেটো, কপি, মরিচ, কুমড়ার চাষ করা হয়ে থাকে। তবে এই তিন ইউনিয়নের সবচেয়ে বেশি চাষ করা হয় সিম। অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় এই তিন ইউনিয়নেই প্রায় বাইশ’ বিঘা জমিতে আগাম শিম চাষ করা হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মণ শিম উৎপাদন হয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানী হয়ে থাকে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্থানীয় কোন পাইকরি বাজার না থাকায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা আসেন না। এ সুযোগে প্রান্তিক শিমচাষিদের বাড়ি, জমি বা ছোট ছোট বাজার থেকে ফরিয়া ব্যবসায়ীরা কম মূল্যে কিনে নেন। এতে সিমসহ অন্যান্যে সবজি চাষিরা নায্য মূল্য পান না কৃষকরা। এদিকে লাভবান হন ফরিয়া ব্যবসায়ীরা।

নওগাঁ সদর উপজেলা ছাড়াও মহাদেবপুরের চান্দাস, ঝাড়গ্রাম, লক্ষীপুর, ভালাইন, এনায়েতপুর ইউনিয়নে আগাম শিম চাষ করা হয়। তবে মহাদেবপুর উপজেলায় তুলনামূলক শিম ফুলে কম পচন রোগ দিয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর শিম কম ধরা ও বিক্রিও কম হয়েছে। এ উপজেলার শতশত শিম চাষিরা ততটা লোকশানের আশঙ্কায় নেই বলে জানিয়েছেন।

 

কৃষকরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর সদর উপজলার সিম চাষিরা আশ্বিন মাসের মধ্যেই আগাম এই শিম প্রতি বিঘায় প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার বিক্রি করা সম্ভব হতো। কিন্তু চলতি বছর একদিকে বৃষ্টি অন্যদিকে গরম আবহাওয়া থাকায় শিমের ফুল ফোটার সাথে সাথেই ফুলের পচন দেখা দেয়। এতে শিমের গাছ আছে ফুল নষ্ট না হওয়ায় সিমের ফল নেই। এখন পর্যন্ত হাতে গোনা শিম চাষি বাজারে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে। এতে অধিকাংশ কৃষকদের লোকসান গুনতে হবে।

সদর উপজেলার বর্ষাইল ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের ইমরান হোসেন জানান, এক বিঘা শিম চাষ করতে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। চলতি বছর শিমে পচা রোগ দেখা দিলেও বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক স্প্রে করেও পচা রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হওয়ায় এখন পর্যন্ত শিম বিক্রি করা সম্ভব হয়নি অধিকাংশ চাষিদের।

শিমে পচন দেয়া দেয়ার সুযোগে বিভিন্ন কিটনাশক ব্যবসায়ীরা এসে তাদের কীটনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু কোন ভাবেই ফুল পচন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পচনের মাত্র অতিরিক্ত হওয়ার সুযোগে চাষিদের টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কীটনাশক ব্যবসায়ীরা। এতে সিম চাষিদের লোকসান গুণতে হবে এমনটিই জানিয়েছেন কৃষকরা।

সদর উপজেলার গবিন্দপুর গ্রামের রতন জানান, শিম ভালো হলে এক বিঘা থেকে প্রায় এক লাখ টাকা বিক্রি হয়ে থাকে। স্থানীয় বাজার না থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা না আসায় তাদের শিম বা সবজি চাষিদের লোকসান গুণতে হয়। কুয়ানগর গ্রামের নূর ইসলাম জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর শিম গাছ ভালো হলেও শিমের ফুলে পচা রোগে দেখা দিয়েছে। শিম গাছে বিভিন্ন কীটনাশক দিয়েও এখন পর্যন্ত পচা রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।

প্রতিদিন পচন ধরা ফুল ও জালা (কুড়ি) শিমের ফেলে দিতে হচ্ছে। এতে প্রতিদিন বাড়তি খরচ হওয়ায় উৎপাদন খচর বৃদ্ধি পাচ্ছে। খরখরিপাড়া গ্রামের আফজাল হোসেন জানান, আগাম এই শিম গত বছরের এই সময়ের মধ্যে প্রতি বিঘা থেকে প্রায় শিম ৩০/৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পচা রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না কোন শিম গাছে ধরেনি। এতে জেলার হাজার হাজার কৃষকদের লোকসান গুণতে হবে। কৃষি বিভাগ থেকেও কোন পরামর্শ না পাওয়ায় অভিযোগ করেন শিম চাষিরা।

বর্ষাইল ইউনিয়ন পরিষদের (৮ নং ওয়ার্ডের) সদস্য আব্দুল ওয়াহেদ পচা রোগের সমস্যা রয়েছে স্বীকার করে বলেন, কৃষি কর্মকর্তারা অফিসে বসে শুধু কাগজকলমে হিসেব ঠিক করেন। কৃষি কর্মকর্তা মাঠ পর্যায় এসে শিম বা সবজি চাষিদের সহযোগিতা না করায় পচা রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবসায়ীরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কৃষক ও কিটনাশক ব্যবসায়ীদের উপর সরকারের নজরদারি বাড়ানো দাবি জানান।

 
বর্ষাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামছুজ্জোহা ঘটু জানান, সদর উপজেলার বর্ষাইল, বক্তারপুর, কীর্ত্তিপুর ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়ির লোকজন সবজির পাশাপাশি শিম চাষ করে থাকেন। শিম চাষ অধিক লাভজনক ফসল হওয়ায় শুধু তার ইউনিয়নে নয়, আশেপাশের ৩/৪টি এবং বদলগাছী উপজেলাতেও ব্যাপকহারে শিম চাষ করা হয়। চাষিদের বিভিন্ন সহযোগিতা বা পরামর্শ দেয়ার সরকারের সার্বক্ষণিক নির্দেশ থাকলেও কৃষি বিভাগ সবজি বা শিম চাষিদের তেমন সহযোগিতা করে না। শিম চাষের একই ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে সবজি চাষিদের অধিকাংশ লোকসান গুণতে হয়।

তিনি বলেন, এই এলাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মণ শিম উৎপাদন হলে পাইকারি বাজার না থাকায় সিমচাষিরা তাদের ফসলের নায্য মূল্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার চকগৌরী, শুক্রবার হাঁপানিয়া আর শনিবার এবং বুধবার তেতুঁলিয়া হাট(বাজার) লাগে।

এই বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় শিম রপ্তানি হয়। আর শিম উৎপাদনের মূল এলাকা থেকে এই তিনটি বাজার বা হাটের দূরত্ব প্রায় তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার। এ জন্যেই অনেক পুরুষ, নারী শিম চাষিরা বা অনেক পরিবার জমি থেকেই কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে থাকেন। কৃষকদের তাদের নায্য মূল্য নিশ্চিত করতে বর্ষাইল ইউনিয়নের পার্শেই থাকা বাজারে সরকারি ভাবে পাইকারি বাজার স্থাপন করা ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক কৃষকদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির দাবি জানান তিনি।

 

এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সত্যব্রত সাহা কৃষকদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে সার্বক্ষণিক শিম বা সবজি চাষিদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ কারণে আগাম শিম চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন পাশাপশি বর্তমানে শিমের দামও ভালো পাচ্ছেন। অপর প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পচন রোগে শিম চাষিদের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক পরিমাণ বা তালিকা কৃষি বিভাগের হাতে নেই’।

স/আ