কাবুলে তালেবানি কর্তৃত্ব ‘কবুল’

আফগানিস্তানে এখনো সরকার গঠিত হয়নি। তাই কূটনৈতিক কথার মারপ্যাঁচে সবাই বলছে, এখনই স্বীকৃতি দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্ন নেই। তবে স্থানীয় সময় সোমবার বিকেল ৩টায় (বাংলাদেশে মধ্যরাত) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনায় দেশটিতে তালেবানের ক্ষমতা দখল বা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নেওয়ার নিন্দা জানায়নি কোনো পক্ষই। বরং কাবুল দখলের পর বিভিন্ন সময় শাসন পরিচালনার বিষয়ে তাদের অঙ্গীকারগুলো আমলে নিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ।

একই সঙ্গে আফগানিস্তান ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদ যে সাত প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, তাতে তালেবানের কাছে নিরাপত্তা, মানবাধিকার, সন্ত্রাসীদের আশ্রয় না দেওয়াসহ সুনির্দিষ্ট কিছু প্রত্যাশা তুলে ধরেছে। ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে ১৩-০ ভোটে। প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো অবস্থান না নিয়ে ‘অ্যাবস্টেইন’ ভোট দিয়েছে চীন ও রাশিয়া।

৩১ আগস্ট আফগান ত্যাগের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই সোমবার মধ্যরাতের পর কাবুল বিমানবন্দর ছেড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সেনাদলটি।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, আন্তর্জাতিক অনেক ইস্যুতে সমান্তরাল অবস্থান নেয় চীন ও রাশিয়া। গত মাসে তালেবান কাবুল পর্যন্ত পৌঁছার আগেই বেইজিংয়ের আশীর্বাদ পেয়েছে। তালেবান নেতাদের সঙ্গে চীনা স্টেট কাউন্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের বৈঠকই শুধু হয়নি, সেই ছবি প্রচারও করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে গত সোমবার রাতের বৈঠকে চীন ও রাশিয়ার ‘অ্যাবস্টেইন’ ভোট দেওয়ার কারণ, তারা মনে করে না যে এ বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণের কোনো যুক্তি আছে। তবে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রত্যাশার সঙ্গে তারা একমত।

নিরাপত্তা পরিষদে আগস্ট মাসের সভাপতির দায়িত্বে ছিল ভারত। আফগানিস্তান নিয়ে বৈঠকটিতে ভারতের পক্ষে সভাপতির আসনে বসেছিলেন পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। বৈঠক শেষে তিনি ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে চাই তা হলো, গৃহীত প্রস্তাবে খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে আফগান ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশকে হুমকি বা হামলার কাজে ব্যবহার হওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে এখানে সন্ত্রাস মোকাবেলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।’

নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবের প্রথম দফায় গত ২৬ আগস্ট কাবুলে হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে। ওই হামলার পর আইএস অনুগত ‘ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রভিন্সের (আইএসকেপি)’ দায় স্বীকার ও তালেবানের বিবৃতি আমলে নেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবের দ্বিতীয় দফায় কোনো দেশে হামলা, হামলার পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ বা অর্থায়নে আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার যাতে না হয়, সেই দাবি জানানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ১২৬৭ (১৯৯৯) নম্বর প্রস্তাবের আওতায় সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এ বিষয়ে ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মুহাম্মদের কথা উল্লেখ করেছেন। ওই দুটি গোষ্ঠীই জাতিসংঘের সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত।

প্রস্তাবের তৃতীয় দফায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জাতিসংঘ ও এর সংস্থাগুলোকে পূর্ণ, নিরাপদ ও অবাধ প্রবেশাধিকার এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। চতুর্থ দফায় নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার, সব পক্ষকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

বিদেশি ও আফগানিস্তান ছাড়তে আগ্রহী নাগরিকদের নিরাপদে দেশ ছাড়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে গত ২৭ আগস্ট তালেবানের বিবৃতিকে আমলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবের পঞ্চম দফায়। ষষ্ঠ দফায় কাবুলে হামিদ কারজাই বিমানবন্দরে আরো সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে ও নিরাপত্তা জোরদারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিমানবন্দর ও এর আশপাশের এলাকা দ্রুত খুলে দিতে বলা হয়েছে ওই প্রস্তাবে। সপ্তম ও শেষ দফায় আফগানিস্তান ইস্যুতে সম্পৃক্ত থাকার অঙ্গীকার করেছে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তির পর বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। ওই চুক্তিতে বলা ছিল, নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে তালেবানের নাম বাদ দিতে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। তালেবানের দৃষ্টিভঙ্গি, অতীত আচরণ নিয়ে পশ্চিমা অনেক দেশে উদ্বেগ থাকলেও তাদের আফগানিস্তানের একটি পক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক বাহিনীর আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া এবং আশরাফ গনি সরকারের অজনপ্রিয়তার সুযোগে প্রায় বিনা বাধায় কাবুল পৌঁছে তালেবান।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের এশিয়াবিষয়ক কর্মসূচির উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্নীতিসহ নানা কারণে কাবুল সরকার তালেবানের চেয়েও অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই সুযোগ নিয়েছে তালেবান।’

এদিকে তালেবানের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথা আগেই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কাবুলে বিমানবন্দরে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সঙ্গে হামলার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আর সুসংহতকরণ, সন্ত্রাস মোকাবেলাসহ অভিন্ন স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তালেবানের সঙ্গে কাজ করতে পারে। তবে তালেবানকেও দেখাতে হবে যে তাদের বর্তমান আচরণ নব্বইয়ের দশকের আচরণের চেয়ে আলাদা।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ