কাকতালীয় ঘটনা কি বিধাতার খেলা নয়?

মোঃ কায়ছার আলী:


লেখক: কায়ছার আলী

বিচিত্র এ পৃথিবীতে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা রকম ঘটনা। কোন রকম যোগসূত্র ছাড়াই অনেক সময় এমন দুই বা ততোধিক ঘটনা ঘটে যার মধ্যে বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলায় এসব ঘটনাকে চিহ্নিত করা হয় কাকতালীয় বা কোইনসিডেন্স্্ হিসেবে। এ ঘটনায় সময়ের ব্যবধান, ভিন্ন দুজন মানুষ, পৃথক দুটি ঘটনা ভিন্ন পরিস্থিতিতেও অনেক সময় মিল বা সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলো বলে থাকে মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ছাড়া কোন কিছুই হয় না।

তাই মানুষেরা কাকতালীয়কে স্রষ্টার রহস্য বা কুদরত বলে ধরে নেয়। তবে কাকতালীয় ঘটনাগুলো মানুষকে কখনো কাঁদায়, কখনো বা হাসায় । গ্যালিলিওর মৃত্যুর বছরে জন্ম হয়েছিল আরেক মহারথি নিউটনের। গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছর পর জন্ম নেন স্টিফেন হকিং। আর আইনস্টাইনের মৃত্যুর বছরে বিল গেটস এবং স্টিভ জবস। আইনস্টাইন এর জন্ম এবং স্টিফেন হকিং এর মৃত্যু ১৪ই মার্চ। এ যেন ইতিহাসের ব্যাটনরেস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সত্য ও সুন্দরের পতাকা বহন করে চলা।

রাশিয়ার জার ২য় নিকোলাইয়ের সঙ্গে চেহারার মিল ছিল ব্রিটিশ রাজা ৫ম জর্জের । তিন বছরের বয়সের ব্যবধান এবং রক্তের সম্পর্ক ছিল তাঁদের, তবে তারা জমজ নন। আবার ইতালির রাজা উমবের্তো ৪৬ বছর পর তাঁর জমজ ভাইকে ফিরে পান এক রেঁস্তোরার মালিক হিসেবে। এর পর জানা গেল দুই উমবের্তোর স্ত্রীদের নামও এক- মারগারিতা। দুজনেরই সংসারে এক ছেলে, নামে এক-ভিত্তোরিও। এর পর দেখা গেল, তাঁরা দুজনেই সামরিক বাহিনীতে একই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।

তাঁরা যুদ্ধের পদকও পেয়েছেন একই দিনে। যুদ্ধের পর দুজনেই নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে লেগে পড়েন। পৃথিবীর ইতিহাসে যত রহস্যময় এবং কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে তার শীর্ষে রয়েছে আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এবং ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে বিস্ময়কর মিল। (১) আব্রাহাম লিংকন ১৮৪৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন এবং কেনেডি ১৯৪৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন। (২) ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁদের উভয়ের একজন করে পুত্র সন্তান মারা যায় । (৩) লিংকনের সেক্রেটারির নাম ছিল কেনেডি এবং কেনেডির সেক্রেটারির নাম ছিল লিংকন। (৪) দুজন প্রেসিডেন্টকেই শুক্রবার গুলি করে হত্যা করা হয়। (৫) উভয় প্রেসিডেন্ট স্ব স্ব স্ত্রীর সামনে নিহত হন। (৬) দ্জুনকেই ঘাতকেরা মাথার পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। (৭) লিংকনকে গুলি করা হয় একটি থিয়েটার হলে এবং গুলি করে ঘাতক একটি গুদামে পালিয়ে যায় আর কেনেডিকে গুলি করা হয় একই গুদাম থেকে এবং গুলির করার পর ঘাতক ঢুকে পড়ে একটি থিয়েটার হলে । (৮) লিংকনের হত্যাকারী জন বুথ ১৮৩৯ সালে এবং কেনেডির হত্যাকারী লি হারভো ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। (৯) উভয় হত্যাকারীর পুরো নাম জন উলকাস বুথ ঔড়যহ ডরষশবং ইড়ড়ঃয এবং লি হারভো ওসওয়ান্ড খবব ঐবৎাবু ঙংধিষফ ইংরেজিতে লিখতে ১৫ টি অক্ষর ব্যবহ্ত হয়। সংক্ষেপে লিখতে ডরষশবং এবং ঙংধিষফ মুল নামে ছিল ৬ অক্ষর। (১০) লিংকনের স্থলাভিষিক্ত প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ১৮০৮ সালে এবং কেনেডির স্থলাভিষিক্ত প্রেসিডেন্ট লিয়ন বি জনসন ১৯০৮ সালে জন্মগ্রহন করেন।

কাকতালীয় এসব ঘটনা মিলের কারণে অনেকে মনে করেন তাঁরা দুজনেই একই ব্যাক্তি ১০০ বছরের ব্যবধানে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আমেরিকানদের সেবার জন্য। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে তিনটি অমর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো। এই তিনজন মানুষের শুধু নিজের ক্ষেত্রেই নয়, তাঁদের পরিবারের জীবনেরও রাজনৈতিক কারনে নেমে আসে অপমৃত্যু। পলাশীর যুদ্ধের কুশীলবদের সবাই আজ মৃত। কিন্তু কাকতালীয় বিষয় হলো পলাশীর যুদ্ধে নবাব তথা জাতির সঙ্গে যারা বেঈমানি করেছিল তাদের কারও ভাগ্যেই স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেনি।

এরা হলেন মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, মহারাজা নন্দকুমার, ঘষেটি বেগম, মীরন, মোহাম্মদীবেগ, ওয়াটসন, ক্রাফটন এবং ওয়াসট। এমনকি লর্ড ক্লাইভ নিজের দেশে ফিরে অপকর্মের দায়ে অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্নহত্যা করেন। ইতিহাস সমৃদ্ধ কোহিনুর হিরা নিয়ে বহু বছর ধরে একটা মিথ রয়েছে যে, পুরুষ শাসকদের জন্য তা অভিশাপ। বর্তমানে ব্রিটিশ রাজসম্পত্তির একটি অংশ অর্থ্যাৎ রাণী এলিজাবেথের মুকুটে তা রয়েছে। আবরার ফাহাদ হত্যার পর পরের বছর ২০১৯ সালে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থানসহ নামের আগে-পরে মিলে ২৫ জন আবরার (১৭ জন মেধায়) চান্স পেয়েছে।

মনে পড়ে কী ২০১০ সালে, দক্ষিন আফ্রিকায় (স্পেন চ্যাম্পিয়ন) অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের শেষের দিকে খেলার পূর্বেই বিশ্ববিখ্যাত তারকা জার্মানির অক্টোপাস পল এর সব কটি ভবিষ্যৎবানী কাকতালীয় ভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ২০১৯ ফাইনালে সবচেয়ে বড় কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে যা সমগ্র বিশ্ববাসী দেখেছে। ইংল্যান্ড ফাইনালে জিতেছে কিন্তু নিউজিল্যান্ড তো হারেনি। ফাইনালের ম্যাচটি ছিল মহানাটকীয় এবং একটা যাদুর ফাইনাল। যার পরতে পরতে ছিল রোমাঞ্চ আর উক্তেজনা। প্রতি মুহুর্তে ম্যাচের রং পাল্টেছে। ভাগ্যদেবী কখনও এদিকে আবার কখনও ওদিকে। ফাইনালের ইতিহাসে নির্ধারিত ১০০ ওভার (৫০+৫০) শেষে ও দুই দল সমান সমান রান ২৪১।

এরপর সুপার ওভার, মোটেও না ! কী এক মহাকাব্যিক ফাইনাল। সেখানেও টাই। দুই দলই ১৫ রান করে নেয়। শেষ পর্যন্ত শিরোপা নির্ধারিত হয় গাণিতিক হিসেবে। যাদের বাউন্ডারি বেশি তারাই শিরোপা পেয়েছে । মূল ইনিংসে নিউজিল্যান্ড ১৬টি বাউন্ডারি মেরেছিল আর ইংল্যান্ড মেরেছিল ২৪টি বাউন্ডারি। একবলে ৬রান (দৌড়ে ২রান, কেউ বলে ১ রান ওভার থ্রোতে ৪ রান) নিয়ে বিতর্ক আছে, প্রশ্ন আছে। জয়ের জন্য দু-দলই সমান পরিশ্রম করেছে।

কোন এমন হল? এটাই এক মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। হয়তো এমন হতে পারে বিধাতা নিজেই চেয়েছেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ ট্রফিটি নিয়ে একটু খেলতে। তবে ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড এর রাষ্ট্র প্রধান একজনই। ইংল্যান্ড স্বাগতিক, বেশি বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলেছে, ক্রিকেটের জন্ম নেতা এবং রানীর জন্মভূমি। তাই ফলাফল যাই ঘটুক, বিশ্বকাপ রাণীর হাতেই থাকবে। অন্য দুটো দেশ ফাইনালে খেললে হয়তে এমন কাকতালীয় ঘটানা ঘটত কী? হার এবং জিত দুটোই রাণীর। একেই বলে ঈড়রহপরফবহপব যা সম্পূর্ন বিধাতার ইচ্ছা।

লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট, ০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, kaisardinajpur@yahoo.com